ফেসবুক লাইভে তামিমের সঙ্গে বিরাট কোহেলি
ফেসবুক লাইভে তামিমের সঙ্গে বিরাট কোহেলি

সহযোগে, আনন্দে

সফল ব্যাটসম্যান, সফল উপস্থাপক

সাত-আট মাস আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুটা ‘অসামাজিক’ ছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ‘অসামাজিক’ বলতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে মানুষ যা যা করেন, তামিম তার কিছুই করতেন না। না দিতেন একটা ছবি পোস্ট, না দিতেন একটা ভিডিও, না দিতেন একটা স্ট্যাটাস। ‘তামিম ইকবাল’ নামে ভেরিফায়েড পেজটায় মাঝেমধ্যে ছবি-ভিডিও এলেও সেটা তো আর তামিম নিজে চালান না। তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে দিনের পর দিন একই ছবি দেখে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন গুটিকয় ফেসবুক বন্ধু।

তারেক মাহমুদ

সেই তামিম করোনাকালে ভাবলেন একটু অন্যভাবে। ছবিটবি নয়, একেবারে ফেসবুক লাইভে তিনি। মানুষ যখন ঘরবন্দী, সময় কাটছে আতঙ্কে, মানুষের মন থেকে যখন আনন্দ ব্যাপারটাই হারিয়ে যেতে বসেছে, তামিম ঠিক করলেন—মানুষকে বিনোদন দিতে হবে। দুঃসময় ভুলিয়ে রাখতে হবে। মুঠোফোনে ব্যক্তিগত আলাপে একদিন বলছিলেন, ‘আমরা, মানে ক্রিকেটারদের কাজ কিন্তু মানুষকে আনন্দ দেওয়াও, মানুষ আমাদের খেলা দেখে বিনোদিত হয়। তাহলে এখন কেন আমরা অন্য কোনোভাবে আনন্দ দেব না!’

যে তামিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে সরে থাকতেন, সেই তিনিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমে পড়লেন মানুষকে আনন্দ দেওয়ার কাজে। সতীর্থ মুশফিকুর রহিমকে ইনস্টাগ্রাম লাইভে এনে শুরু। এরপর মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে তালিকাটা শুধু দীর্ঘই হতে থাকল।

মূলত মাশরাফিকে আনার পরই তামিমের মধ্যে আসে উপলব্ধিটা। করোনার দুঃসময়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার এই কাজ যতটা সম্ভব চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, আর কিছুই নয়। মাশরাফিকে নিয়ে করা ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে আসা কিছু মন্তব্য।

সেদিনের মন্তব্যের একটি লিখেছিলেন ময়মনসিংহ থেকে এক চিকিৎসক। তামিম-মাশরাফির অনুষ্ঠানের ভিডিওতে তাঁর মন্তব্য, ‘আমি একজন ডাক্তার ও করোনা পজিটিভ। এই অনুষ্ঠানটা খুব উপভোগ করি। অসংখ্য ধন্যবাদ তামিম।’

মানুষ যখন ঘরবন্দী, সময় কাটছে আতঙ্কে, মানুষের মন থেকে যখন আনন্দ ব্যাপারটাই হারিয়ে যেতে বসেছে, তামিম ঠিক করলেন—মানুষকে বিনোদন দিতে হবে।

এ রকম আরও কিছু মন্তব্য তামিমের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। তামিম অনুভব করলেন, তাঁর এ অনুষ্ঠান মানুষের টেনশন ভুলে থাকার অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। কে আসবেন, কার সঙ্গে হবে তামিমের আড্ডা? সময় যে কীভাবে কেটে যাবে, টেরই পাওয়া যাবে না। টেলিভিশনে করোনায় আক্রান্ত আর মৃত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান শুনে শুনে মনকে ভয়ার্ত করে তোলার চেয়ে এই ঢের ভালো। জাতীয় দলের সিনিয়র সতীর্থদের থেকে শুরু করে তরুণ ক্রিকেটাররাও হাজির হতে লাগলেন তামিমের অনুষ্ঠানে। এসেছেন সাবেক ক্রিকেটাররাও।

একটা পর্যায়ে তামিমের ফেসবুক লাইভ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেল। সেখানেও আড্ডায় যোগ দেওয়া নামগুলো বেশ জ্বলজ্বলে ক্রিকেট দুনিয়ায়। রোহিত শর্মা, ফাফ ডু প্লেসি, কেন উইলিয়ামসন, ওয়াসিম আকরাম, বিরাট কোহলি—বাংলাদেশ ওপেনারের আমন্ত্রণে কে সাড়া দেননি!

তামিম শুধু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় তাঁদের জানিয়েছেন, করোনাকালে মানুষকে নির্ভার রাখতে খেলোয়াড়দের নিয়ে তিনি একটা অনুষ্ঠান করছেন। ফেসবুক লাইভে ভক্তদের সামনে ক্রিকেটারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। মাঠের-ড্রেসিংরুমের মজার সব ঘটনা, স্মরণীয় মুহূর্ত, কখনো কখনো ব্যক্তিগত জীবন—আড্ডার উপজীব্য অনেক কিছুই। তামিমের প্রস্তাবে রাজি হতে সময় নেননি কেউই। শুধু বিরাট কোহলি একটা শর্ত দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে স্ত্রী আনুশকাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তামিমের সেটার প্রয়োজনও হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে আনুশকা হয়তো কোহলির বড় অনুষঙ্গ, কিন্তু তামিমের অনুষ্ঠান ‘হিট’ হতে তাঁদের যুগল উপস্থিতির দরকার নেই। আলোচনার বিষয় যখন ক্রিকেট, তামিম-কোহলি জুটির পর আর কি কিছু লাগে?

মজার ব্যাপার, করোনাকালে এত জনপ্রিয়তা পেল যে অনুষ্ঠান, সেটির কিন্তু কোনো নাম ছিল না! তামিমের ফেসবুক লাইভ, তামিমের আড্ডা—মানুষ এসবেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। ক্রিকেটার তামিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হয়ে দাঁড়ালেন একটা ব্র্যান্ড! এ জন্য অবশ্য কিছু কষ্টও করতে হয়েছে তাঁকে। যাকে অতিথি হিসেবে আনবেন, অনুষ্ঠানের আগে তাঁর সম্পর্কে জানা, তাঁকে কী প্রশ্ন করা যায়, সেটি নিয়ে ছোটখাটো গবেষণাই করে ফেলতেন তিনি।

খেলতে নামার আগে অনুশীলনে যেমন নিজেকে তৈরি করে নেন, ঠিক তেমন। সফল ব্যাটসম্যান থেকে সফল ‘উপস্থাপক’ তো আর এমনি এমনি হওয়া যায় না!


তারেক মাহমুদপ্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক