সরেজমিন: কোম্পানীগঞ্জ

সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার, শিশুর কান্না, মায়ের দুশ্চিন্তা

এমন অন্ধকারেই কলেজের বারান্দার এক কোণে রান্না চড়িয়েছিলেন রিনা বেগম। গত বুধবার রাতে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। আশ্রয়কেন্দ্রের কক্ষগুলোতে অন্ধকার। তার মধ্যে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বেঞ্চে বসে রয়েছেন হেলেনা বেগম। কোলে শিশুসন্তান। সে শুধু কাঁদছে। আর হেলেনা তাকে বুকের দুধ পান করিয়ে থামানোর চেষ্টা করছেন।

শিশুটি কাঁদছে কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে হেলেনা জানালেন, তাঁর সন্তান পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না। পেট ভরছে না। তাই কাঁদছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ে খাইলে না ছায়ে পাইত? আমি খাইতে পাররাম না, ফুরুতার খানি (দুধ) আইত কই তনে।’

হেলেনা জানান, তিনি গত বুধবার পর্যন্ত আগের চার দিনে মাত্র এক বেলা খিচুড়ি পেয়েছিলেন। বাকি সময় চিড়া বা অন্য কোনো শুকনা খাবার খেয়ে কাটাতে হয়েছে।

হেলেনা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজে আশ্রিতদের একজন। এই কলেজের চারটি ভবনে গত বুধবার পর্যন্ত প্রায় দেড় শ বন্যাদুর্গত পরিবার আশ্রিত ছিল।

মায়ে খাইলে না ছায়ে পাইত? আমি খাইতে পাররাম না, ফুরুতার খানি (দুধ) আইত কই তনে।
হেলেনা বেগম, আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মা

পানি কমতে শুরু করায় গত বুধবার কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যায়।

আশ্রয়কেন্দ্রটিতে গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অবস্থান করে আশ্রিত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, গত সাত দিনে তাঁদের বেশির ভাগ কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি।

সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ–ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরেই এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজের অবস্থান। মহাসড়ক থেকে কলেজ প্রাঙ্গণ পর্যন্ত অনেক জায়গায় পানি কমে রাস্তা জেগে উঠেছে। তাই একটু কষ্ট হলেও হেঁটে কলেজটিতে যাওয়া যায়।

তবু সেখানে কেন সরকারি ত্রাণ পৌঁছায়নি, জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসি কান্ত হাজং প্রথম আলোকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কলেজটির আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সরকারি ত্রাণ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিভাবে ত্রাণ দিতে আসা আরও অন্তত ছয় থেকে আটটি সংগঠনকে তিনি ওই কলেজে পাঠিয়েছেন।

কলেজটির আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ দেওয়া হয়েছিল কি না, তা জানতে কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী আবদুল অদুদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর স্ত্রী সুলতানা আক্তার ফোন ধরেন। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ত্রাণ বিতরণে গিয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন। বিশ্রাম নিচ্ছেন, কথা বলতে পারবেন না।

এদিকে এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজের দপ্তরি ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ জুন থেকে সেখানে বন্যাদুর্গত মানুষ আশ্রয় নেওয়া শুরু করেন। কিন্তু সেখানে সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ কিংবা খাদ্যসহায়তা পৌঁছায়নি। শুধু স্থানীয় একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য তাঁর এলাকার ভোটার, এমন ১০টি পরিবারকে ত্রাণ দিয়েছেন। তা–ও শুধু চাল।

ওই আশ্রয়কেন্দ্রের ১৫টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গত বুধবার সন্ধ্যায় কথা হয়। তাদের মধ্যে দুটি পরিবারের সদস্যরা বুধবার রাতে রান্না করে খাবার খেয়েছেন। সাতটি পরিবারের সদস্যরা চিড়া, মুড়ি অথবা বিস্কুট খেয়েছেন। আর ছয়টি পরিবারের সদস্যরা রাতে কিছুই খাননি। না খেয়ে থাকা কেউ কেউ বলেছেন, খাবারের যেহেতু অভাব, সেহেতু তিন বেলা খাবার খাওয়া কঠিন।

মায়েদের কষ্টটা বেশি। তাঁরা নিজেরা না খেয়ে, কম খেয়ে থাকলেও শিশুসন্তানকে খাবার দিতে হয়। নইলে তাদের কান্না থামে না।

বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ পুষ্টি সমিতির প্রেসিডেন্ট এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, মা যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার না পেলে মায়ের বুকে দুধ কম তৈরি হতে পারে। বন্যার সময় যেসব আশ্রয়কেন্দ্রে মা ও শিশু থাকবে, সেখানে ওই মা ও শিশুর জন্য একটু বাড়তি ত্রাণ দিতে হবে।

এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজের বাইরের দিকে কয়েকটি বাতি থাকলেও কক্ষগুলোতে সে ব্যবস্থা নেই। তাই সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার নামে। গত বুধবার এমন অন্ধকারেই আশ্রয়কেন্দ্রের বারান্দার এক কোণে রান্না চড়িয়েছিলেন রিনা বেগম নামের এক নারী। তাঁর এক হাতে একটি মোমবাতি। তাঁর পরিবার রাতে রান্না করা খাবার খেতে পেরেছে।

রান্নার কাজে রিনার যখন এই ব্যস্ততা, তখন শ্রেণিকক্ষের ভেতরে আশ্রয় নেওয়া পাথরশ্রমিক লায়েক আহমেদ ও গৃহিণী মরিয়ম বেগম ছিলেন তাঁদের অসুস্থ সন্তানকে ওষুধ খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত। কথা বলে জানা গেল, গত সোমবার থেকে শিশুটির জ্বর। তার বাবার কাছে ওষুধ কেনার মতো টাকা ছিল না। গত বুধবার পানি কিছুটা কমলে স্থানীয় বাজারে গিয়ে তিনি পরিচিত ওষুধের দোকান খোলা পান। সেখান থেকে বাকিতে ওষুধ আনেন।

লায়েক বলেন, হঠাৎ পানির ঢল শুরু হলে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। সেদিন তাঁর পকেটে ছিল মাত্র ১০০ টাকা।

গবাদিপশু নিয়েও দুশ্চিন্তা

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষেরা গবাদিপশু নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কেউ কেউ গরু, ভেড়া কিংবা ছাগল আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। অনেকেই জানালেন, রাত হলেই তাঁদের উৎকণ্ঠা বাড়ে। কারণ তাঁরা শুনেছেন, অনেক এলাকায় নাকি ডাকাতি হচ্ছে। ফেলে আসা ঘরবাড়ি থেকেও চুরি খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে অনেকেই রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে পালা করে পাহারা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

যেমন জান্নাতুল জয়নব নামের এক নারী গত বুধবার রাতে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট পরপর বারান্দায় রাখা গরুটিকে দেখে আসছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরুর চিন্তায় রাইত ঘুম আয়ে না, আখতা ঘুম ভাঙ্গে। চাইরবাইদি হুনরাম ডাকাতি অর। এর লাগি একটু বাদে বাদে হজাগ অইয়া গরু দেখাত আই।’