নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা

সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত

নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন
নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন
>

• অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নুর উদ্দিন ও শাহাদাত
• তাঁরা দুজনই এ মামলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বর আসামি
• সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলে এ দুজন গা ঢাকা দেন
• হামলাকারীদের সম্পর্কে এই দুজন জানতে পারেন

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম সরাসরি জড়িত বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁরা দুজনই রয়েছেন সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁদের ধরতে পারলেই মূল রহস্য বের হবে বলে এলাকার মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধারণা। অবশ্য মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে সন্দেহভাজনদের ধরতে বুধবার রাত থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অভিযান শুরু করেছে।

মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারী এবং স্থানীয় লোকজনের জোর ধারণা, এ দুজন ধরা পড়লেই নুসরাত জাহানের খুনিদের শনাক্ত করা সহজ হবে। ৫ এপ্রিল রাতে দুজনকে ও ৬ এপ্রিল ঘটনার দিন সকালে নুর উদ্দিনকে মাদ্রাসার মূল ফটকে দেখা গেছে বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন। তাঁরা দুজনই এ মামলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বর আসামি।

সরেজমিনে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর মুক্তির দাবিতে ‘সিরাজ উদ দৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে কমিটি গঠন করা হয়। ২০ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক হন শাহাদাত হোসেন। তাঁদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে গত ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। তাঁরাই নুসরাতের সমর্থকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী জানান, ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাতের গায়ে দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় বোরকা ও নেকাব পরা যে চারজন অংশ নেন, তাঁদের সম্পর্কে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত অনেক কিছু জানতে পারেন। নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলে এ দুজন গা ঢাকা দেন। থানা-পুলিশও শুরুর দিকে এদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি; বরং এটি আত্মহত্যার চেষ্টা বলে পুলিশ আকার-ইঙ্গিতে বক্তব্য দিয়েছিল।

মাদ্রাসার দপ্তরি নুরুল আমিন মনে করেন, বোরকা পরা চারজনের সঙ্গে নুর উদ্দিন ও শাহাদাতের যোগসাজশ থাকতে পারে। বিভিন্ন সময় অধ্যক্ষের কক্ষে তাঁরা অবাধে যাতায়াত করতেন। পরীক্ষার কেন্দ্রে ১৪৪ ধারা থাকলেও এ দুজনের প্রবেশে বাধা ছিল না।

নুরুল আমিনের বক্তব্যকে সমর্থন করেন মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী মো. মোস্তফা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নুর উদ্দিন ও শাহাদাতের সঙ্গে অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সবাই জানে। কিন্তু কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে তাঁরা চাপ প্রয়োগ করেন। মামলার কারণেই নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হয়।

নুর উদ্দিন ও শাহাদাত দুজনই এই মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র। নুর উদ্দিনের বাড়ি মাদ্রাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চর চান্দিয়ায়। শাহাদাতের বাড়ি মাদ্রাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে উপজেলার চর চান্দিয়া ইউনিয়নের ভূঁঞা বাজারে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দাখিল পরীক্ষায় এ মাদ্রাসা কেন্দ্রে ৫৮৭ জন অংশ নেয়। তখন প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন নুর উদ্দিন। অধ্যক্ষ ও নুর উদ্দিন চাঁদা ভাগাভাগি করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দপ্তরি নুরুল আমিন বলেন, আলিম পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদায় অনুষ্ঠানের কথা বলে নুর উদ্দিন ও তাঁর কয়েক সঙ্গী ৬০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান হওয়ার আগের দিন অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হন।

সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মতো আমারও দৃঢ়বিশ্বাস, নুর উদ্দিন ও শাহাদাতের সঙ্গে বোরকা পরা চারজনের সম্পর্ক রয়েছে। আমি শুরু থেকে বলে আসছি, এই দুজন ধরা পড়লে নুসরাতের খুনিদের শনাক্ত করা যাবে। আমার বিশ্বাস, বোরকা পরা চারজনের মধ্যে যদি কোনো পুরুষ সদস্য থাকে, তাহলে তাঁরা নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হতে পারে। পিবিআই ঘটনার প্রকৃত রহস্য বের করতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।’

পিবিআইয়ের উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নুর উদ্দিন ও শাহাদাতের ব্যাপারে আমরা ওয়াকিবহাল। এই দুজনের ব্যাপারে শিগগিরই ভালো খবর দিতে পারব। আমাদের আসল লক্ষ্য, মূল খুনিদের ধরে আইনের আওতায় আনা।’