সন্তান জন্ম দিয়েই বিসিএস দেওয়া সুপর্ণা এখন খামারিদের ‘ডাক্তার দিদিমণি’

প্রথম আলো কার্যালয়ে সুপর্ণা দে
ছবি: আশরাফুল আলম

সুপর্ণা দের বিয়ে হয়েছিল সাড়ে ১৯ বছর বয়সে। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি ৩৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন। শেষ পরীক্ষার দিন ভোরে তিনি পুত্রসন্তানের মা হন। সেদিন ভোরে হাসপাতালে স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মদানের পর সকাল ১০টায় পরীক্ষার হলে পৌঁছান। চার ঘণ্টা পরীক্ষা দেন। লাইভস্টক (প্রাণিসম্পদ) ক্যাডারে ১১তম হন তিনি। দুর্দমনীয় সুপর্ণা এখন খাগড়াছড়ির দুর্গম লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন। স্থানীয় খামারিদের কাছে তিনি হলেন ‘ডাক্তার দিদিমণি’।

২০১৬ সালের ২০ আগস্ট প্রথম আলোতে ‘সুপর্ণার স্বপ্ন পূরণ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে সুপর্ণার সন্তান জন্ম দিয়েই বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সংগ্রামের কথা ছাপা হয়েছিল। সুপর্ণা প্রশিক্ষক হিসেবে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে বর্তমানে ঢাকায় রয়েছেন। প্রশিক্ষণ চলবে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত। গত সোমবার রাতে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে সুপর্ণার সঙ্গে কথা হয়। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী টিটো সিকদার, মেয়ে সম্পূর্ণা সিকদার ও ছেলে শৌর্য নীল সিকদার। আলাপকালে সুপর্ণা জানান, তাঁর যে সংগ্রাম, তাতে তাঁর মা–বাবার পাশাপাশি স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ পরিবারের সবার সহযোগিতা ছিল।

সুপর্ণার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন দুই সন্তান সামলাচ্ছিলেন টিটো। সুপর্ণা বলেন, ‘দুই ছেলে-মেয়ের মা, তারপরও আমি পার্বত্য এলাকার দুর্গম উপজেলায় সাড়ে তিন বছর কাটিয়ে দিচ্ছি। বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নিচ্ছি। কখনো কোনো দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়নি। কারণ, পরিবার আমার পাশে আছে। আমার বিভাগের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহায়তা পাচ্ছি।’

স্বামী ও দুই সন্তানের সঙ্গে সুপর্ণা দে

সুপর্ণা জানান, তাঁর জন্য স্বামী টিটো নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন শেয়ার ব্যবসার পাশাপাশি পৈতৃক সম্পত্তি দেখভাল করেন। সন্তানদের দেখাশোনা করেন। বিষয়টি অবশ্য অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে যদি সমস্যা না থাকে, তাহলে অন্যের কথায় কী আসে যায়!’

সুপর্ণার পাশে বসে থাকা টিটো যোগ করেন, ‘আমার সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক। ফলে একজন পুরুষ চাকরি করছেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, এটা নিয়ে অনেকেই টিপ্পনি কাটেন।’

বর্তমান কর্মস্থল সম্পর্কে সুপর্ণা জানান, ২০১৭ সালের মে মাসে তিনি লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে কাজে যোগ দেন। তাঁর আগে এই উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে কোনো নারী দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি তাঁর চলতি দায়িত্বের পাশাপাশি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বও পালন করছেন। তিনিই তাঁর কার্যালয়ের প্রধান। সেখানে একটানা সাড়ে তিন বছর কাজ করার রেকর্ডও এখন তাঁর। পার্বত্য দুর্গম এলাকা বলে জনবলের সংকট রয়েছে। ১১ জনের জায়গায় আছেন মাত্র ৪ জন। এই চারজনকে নিয়েই কাজ করেন তিনি।

সুপর্ণা বলেন, ‘দুর্গম এলাকা বলে পায়ে হেঁটে বা মোটরসাইকেলে চড়ে বেশির ভাগ জায়গায় যেতে হয়। এলাকার সব খামারি আমাকে চেনেন। তাঁদের কাছে আমি হলাম ডাক্তার দিদিমণি। গরু-ছাগলের অস্ত্রোপচার, বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ, ম্যালেরিয়া-জলাতঙ্ক প্রতিরোধে ব্যবস্থা, খামারিদের খামার পরিদর্শন, পরামর্শ দেওয়া—সব কাজই করতে হয়। মাসের প্রায় ৩০ দিনই এলাকার কোনো না কোনো সভায় অংশ নিতে হয়।’

সুপর্ণা দে ২০১৭ সালে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে যোগ দেন

হাসতে হাসতে সুপর্ণা বলেন, ভেটেরিনারি সার্জন মানে ‘গরুর ডাক্তার’ বলে সমাজের কেউ কেউ হাসাহাসি করে। তবে ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে কাজ করতে পেরে তিনি গর্ববোধ করেন।

দুর্গম এলাকায় এত দিন ধরে কাজ করায় অনেকেই অবাক হন বলে জানান সুপর্ণা। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী স্যার, সচিব স্যারসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানতে চান, এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, বদলি হয়ে কোথাও যেতে চাই কি না। তবে আমি সব সময় বলে আসছি, এখানে আমি ভালো আছি। এ কথা শুনে সবাই অবাক হন। আমি মনে করি, সবাই যদি দুর্গম এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যান, তাহলে উন্নয়ন হবে কীভাবে?’

কর্মনিষ্ঠার বিপরীতে দারুণ স্বীকৃতিও মিলেছে বলে জানালেন সুপর্ণা। গত বছর শিক্ষা ও চাকরি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন তিনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মেধাবৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। এই বৃত্তি নিয়ে মালয়েশিয়ার পুত্রা ইউনিভার্সিটিতে ১২ দিন ‘ভিজিট’ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন সুপর্ণা দে

সুপর্ণা তাঁর কর্মজীবনে বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছেন। চাকরির পর ৯টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ৬৪তম বনিয়াদি কোর্সে তৃতীয় হয়েছিলেন তিনি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পাহাড়ি এলাকায় ম্যালেরিয়ার ‘আউটব্রেক’ নিয়ে দুই মাসের একটা কোর্সের আয়োজন করেছিল ২০১৮ সালে। মানুষের চিকিৎসক ও ভেটেরিনারি সার্জন মিলে মোট ২০ জন এই কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সুপর্ণা ছিলেন একমাত্র নারী। এই কোর্সের জন্য লক্ষ্মীছড়ির প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় তিনি সার্ভে করেছিলেন, যা প্রশংসিত হয়।

সুপর্ণার নিজের ও শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। তিনি ২০০৬ সালে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি অ্যান্ড বায়োমেডিক্যাল সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ার সময়ই তাঁর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ও বিসিএসের প্রস্তুতিতে স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির সহায়তা পান তিনি। সুপর্ণা বলেন, ‘পুত্রবধূ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, এটা নিয়ে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বেশ গর্ব করেন।’

ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে কাজ করতে পেরে গর্ববোধ করেন সুপর্ণা দে

সুপর্ণার ‘সংসার’ এখন দুই জায়গায়। কর্মসূত্রে নিজে থাকেন লক্ষ্মীছড়িতে। আর সন্তানদের নিয়ে স্বামী থাকেন চট্টগ্রামে। স্বামী যখন সময় পান, সন্তানদের নিয়ে লক্ষ্মীছড়িতে হাজির হন। আবার সুপর্ণা ছুটি পেলে নিজেই চলে যান চট্টগ্রামে।

৩৩ বছর বয়সী সুপর্ণা বলেন, ‘আমি আরও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন আমার স্বামীরও।’