সন্তানের জন্য খোলা হাওয়া

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৮ মার্চ দেশে প্রথম কারও মৃত্যু হয়। এর আগে এ নিয়ে কেউ তেমন গা করছিল না। এরপর তো ২৬ মার্চ থেকে অফিস–আদালতই বন্ধ হয়ে গেল। পুরো দেশ হয়ে গেল গৃহবন্দী। কী এক অদ্ভুত অদ্ভুত পরিবেশে শুরু হয়ে গেল আমাদের জীবনযাপন। যদিও অবশ্য তার কিছুদিন আগে থেকেই আমি গৃহবন্দী অবস্থায় আছি। বর্তমানে আমি গর্ভবতী।

গত বছর গর্ভাবস্থার সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমি আমার প্রথম সন্তানকে হারাই। তাই স্বাভাবিকভাবেই এবার শুরু থেকেই আমি খুব সতর্ক। চিকিৎসকের পরামর্শ খুব করে মেনে চলছি। এরই মধ্যে আমার চিকিৎসা–প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৫ মার্চ আমার একটা অস্ত্রোপচার হলো। এরপর সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। চলে এলাম মায়ের কাছে।

আমি গৃহবন্দী, পরিপূর্ণ বিশ্রামে আছি। তাই মনে হতে পারে, আমার ওপর করোনার কোনো প্রভাব পড়ছে না। তা কিন্তু মোটেই নয়। আমার বিড়ম্বনাও কোনো অংশেই কম নয়। গর্ভবতীকে ঘিরেও কাজের ঝামেলা কম নয়। কিন্তু বাসায় কাজের লোক আসা বাদ দেওয়া হয়েছে। মাকেই বাসার সব কাজের সঙ্গে আমার সেবা করতে হচ্ছে। একজন নার্স প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে এসে আমাকে ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এমন অবস্থায় মোটেই চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছি না। সামনে রুটিন চেকআপের সময় ঘনিয়ে আসছে। যেতে পারব কি না জানি না। আমার মাথার কাছে সাইড টেবিলে ওষুধের সঙ্গে স্যানিটাইজার আর ওয়েট টিস্যু রাখা আছে। সেসবই বারবার ব্যবহার করছি। আর নিয়ম করে গরম পানি কিংবা লেবু বা আদা–চা পান করছি।

অস্ত্রোপচারের আগে ভেবেছিলাম, একজন গৃহকর্মী ঠিক করে বনশ্রীতে নিজের সংসারে ফিরে যাব। করোনাভাইরাস পুরো পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে। আপাতত তো সেটি আর মোটেই সম্ভব নয়। আমার স্বামী একটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করেন। ঘরে বসেই এখন অফিস করছেন। প্রতিদিন ওর সঙ্গে ভিডিওকলে যোগাযোগ হয়। এর মধ্যেও আমাকে কয়েক দিন আধা ঘণ্টার জন্য হলেও দেখে গেছে। তবে আমার সুরক্ষার দিকে খেয়াল রেখে সতর্কতাও মেনেছে। তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখেছে, মাস্ক পরে থেকেছে, হাত পরিষ্কার করেছে।

গর্ভাবস্থায় বাইরের খাবার খাওয়া ঠিক নয়। তবু কখনো কখনো তো একটু–আধটু ইচ্ছে করেই। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করলেও খাবার আনাতে পারছি না। আবার রান্না করে খাবার তৈরি করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মায়ের ওপরে অতিরিক্ত চাপ দিতেও মোটেই ইচ্ছে করে না।

মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখি। বাসার সামনে কুকুরগুলো না খেয়ে ঝিমাতে থাকে। খুব মায়া লাগে। বারান্দা দিয়ে ওদের জন্য মাঝেমধ্যে বিস্কুট ছুড়ে দিই।

সারা দিন বাসায় থেকে বিছানায় শুয়ে–বসে ইবাদত, ফেসবুক আর ভিডিও চ্যাট করে সময় কাটাই। দিন কাটছে টিভি দেখে আতঙ্কের মধ্যে। শুধু ভাবছি, সামনের দিনগুলো কেমন হবে, কী হবে ভবিষ্যৎ? বুকে আশাও রাখি, ইনশা আল্লাহ, জলদিই করোনামুক্ত হবে দেশ, করোনামুক্ত হবে বিশ্ববাসী। আমার অনাগত সন্তান নিশ্চয়ই নতুন আলোয় খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেবে।