একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দুই নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশ আর ভারতের ঘনিষ্ঠতার শুরু। গত ৫০ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই গত পাঁচ দশকের সম্পর্কের মূল্যায়ন করে ভবিষ্যতের পথনকশা কেমন হবে, সেটাই ঠিক করতে চায় দুই দেশ।
আজ শনিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁদের একান্ত আর সহযোগীদের নিয়ে বসে সম্পর্কের ভবিষ্যতের ছবিটা কেমন হতে পারে, তার একটি ইঙ্গিত দেবেন।
সফরের দ্বিতীয় দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসবেন। বেলা তিনটার দিকে দুই প্রধানমন্ত্রী একান্তে আলোচনা করবেন। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসবেন তাঁরা।
আজ সকালে সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা শেষে সইয়ের জন্য পাঁচটি সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে ভার্চ্যুয়ালি।
আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত সইয়ের জন্য চূড়ান্ত সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে দুর্যোগ দমনে সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূরের পদক্ষেপ, দুই দেশের জাতীয় ক্যাডেট কোরের মধ্যে সহযোগিতা এবং তথ্য যোগাযোগ ও রাজশাহীতে খেলার মাঠ বিষয়ে দুই প্রকল্প বাস্তবায়ন। তবে শেষ মুহূর্তে এই সংখ্যা বাড়তে পারে বলে সরকারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, দুই প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আলোচনাতে সম্পর্কের অতীত পর্যালোচনা করবেন। সেই সঙ্গে আগামী এক–দুই দশকে সম্পর্কটাকে কোথায় দেখতে চান, তা নিয়ে কথা বলবেন।
নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের সফরে গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকায় আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর এই সফর।
বাংলাদেশের কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত এক দশকে ভারতের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সহযোগিতা করেছে। এটি দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তাই সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থে বাংলাদেশ এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর বাণিজ্য বাড়াতে হলে সংযুক্তি অপরিহার্য। আর সংযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সহযোগিতাটা শুধু দুই দেশের মাঝে সীমিত না রেখে নেপাল ও ভুটানকেও যুক্ত করতে চায়। কারণ, একসঙ্গে চার দেশের উন্নতি একটি নতুন দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বুধবার গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের প্রেসিডেন্ট ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় সংযুক্তিতে বিশেষ জোর দিয়েছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনাতেও প্রসঙ্গটি তুলবেন।
দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় সংযুক্তি, ব্যবসার পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোও প্রাধান্য পাবে।
উদ্বোধন হবে যে প্রকল্পগুলো
নরেন্দ্র মোদির সফরে যে আটটি প্রকল্প উদ্বোধনের কথা, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু–বাপু ডিজিটাল জাদুঘরের উদ্বোধন গতকাল হয়ে গেছে। অন্য সাতটি প্রকল্প উদ্বোধন হবে আজ। সেগুলো হচ্ছে শিলাইদহের সংস্কারকৃত কুঠিবাড়ি, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি সমাধি, বাংলাদেশের কাছে ভারতের ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু, দুটি সীমান্ত হাট চালু এবং স্মারক ডাকটিকিটের মোড়ক উন্মোচন। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে প্রক্রিয়াগত সমস্যা থাকায় স্বাধীনতা সড়ক এবং চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন উদ্বোধন হবে। তবে সড়কে চলাচল আর ট্রেনে যাত্রীদের যাতায়াত শুরু হতে কিছুদিন সময় লাগবে।
সংযুক্তির কেন্দ্রে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা
বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতায় ভারত সাম্প্রতিক সময়ে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে মনোযোগী। এই পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক, রেল, নৌ আর সমুদ্রপথে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে। তাই বাংলাদেশ দুই দেশের বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় নেপালকে এ দেশের নৌপথ ও ভূখণ্ড ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করতে দিতে চায়।
এর পাশাপাশি ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে চায়। এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এর মধ্যেই ভারতকে সড়ক ও রেলপথে নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঁচটি রুটে পণ্যবাহী যান চলাচলের অনুরোধ জানিয়েছে। ঢাকার বৈঠকে বিষয়টি তুলে তা দ্রুত বাস্তবায়নের অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ। সড়কপথে নেপালের জন্য মেছিনগর, বিরাটনগর, বীরগঞ্জ ও রেলপথে রোহানপুর-সিংহাবাদে অনুমতির অনুরোধ জানিয়েছে। আর ভুটানের সঙ্গে রেলপথে চিলাহাটি-হলদিবাড়ীতে যুক্ত হতে অনুমতির অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ঢাকার কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অন্য দেশ মিয়ানমারের সঙ্গেও সংযুক্তিতে আগ্রহী। এই লক্ষ্য থেকে সম্প্রতি ভারতকে ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে আগ্রহী দেখিয়েছে। বাংলাদেশ মনে করে, ভারতের সহযোগিতা থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সঙ্গে ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া সহজ হবে।