দেশের সংস্কৃতিচর্চা কোন পথে

‘সংস্কৃতিচর্চা থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে’

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে এসে বাংলাদেশের সংস্কৃতির হাল–হকিকত এখন কেমন? বাঙালির বর্ষবরণের ক্ষণে তা বুঝে নিতে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছে লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির
ছবি :  প্রথম আলো
প্রশ্ন

১. ১৯৫০–৬০–এর দশকে এ দেশের সংস্কৃতিচর্চা অভূতপূর্ব কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। অতিমারির সময়টুকু বাদ দিলে দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু অনেকে বলছেন, এই চর্চা থেকে দেশের বৃহত্তর মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

শাহরিয়ার কবির : ১৯৫০–৬০–এর দশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের নেপথ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, পরমত সহিষ্ণুতা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার বড় ভূমিকা ছিল। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় ভাস্বর বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছিল প্রগতিবাদী রাজনীতির। তারই পরম্পরায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বপ্ন ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র হবে সম্প্রীতি ও মানবতার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপহার েদওয়া ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল সব ধর্মের সমান অধিকার এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আমাদের সব অর্জন বদলে দেওয়া হলো। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে উৎসাহিত করে রাজনীতিতে মৌলবাদের উত্থান ঘটালেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর প্রথম কুঠারাঘাত তিনিই করেছিলেন। এরপর যে শাসকই এসেছেন, একই ধারায় চলেছেন।

যাত্রা, পালাগান, কবিগান, মেলা তো বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু গ্রামে গ্রামে কি এখন সেসব আছে? পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের জন্য এখন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। অথচ যাত্রাপালা আর কবিগানের জন্য নিতে হয় অনুমতি। বঙ্গবন্ধুর সময় তো এসব বিধিনিষেধ ছিল না।

এক যুগের বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি যে ’৭২-এর সংবিধান, সেখানে ফেরার কথা তারা এখন মুখেই আনে না। মুখে তারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, কিন্তু কাজে প্রতিফলন দেখি না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতিপত্তি বেড়েছে। তাদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। গ্রামে–শহরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরা অনেক বেশি সক্রিয়। তাদের ওয়াজে সরকারের কোনো কোনো জনপ্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকতে দেখি। অথচ পাঠাগার, মিলনায়তন বা খেলার মাঠ গড়ার কোনো উদ্যোগ নেই। সংস্কৃতি নিয়ে বড় পরিকল্পনা নেই। তাই সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক উৎসব করা হলেও সেগুলো সপ্রাণ হতে পারছে না। এভাবেই আমাদের সংস্কৃতি থেকে মানুষ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন

২. স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে সরকারি–বেসরকারি নানা স্তরে দুই বছর ব্যাপক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে কতটা ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারলাম?

শাহরিয়ার কবির : গত দুই বছরে মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অধিকাংশ অনুষ্ঠান সরকারি উদ্যোগেই হয়েছে। এগুলোর দরকারও আছে। তবে প্রাপ্তির হিসাব কষলে দেখি, মানুষের মধ্যে ওগুলো খুব একটা রেখাপাত করেনি। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশিত অজস্র বইয়ের বেশির ভাগই অগভীর ও স্তুতিতে ভরা। ২০১৮ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর প্রামাণ্য জীবনী বের করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বই দুটি করা হোক। পৃথিবীর নানা দেশেই স্বাধীনতাসংগ্রাম ও জাতীয় নেতাদের ওপর এমন বই আছে। কিন্তু তা করা হলো না।

অঢেল টাকা খরচ করে উৎসব করা হলো বটে, তবে তার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কতটা আত্মস্থ করতে পারলাম? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দর্পণ হলো ’৭২-এর সংবিধান। বাঙালি সংস্কৃতির শক্তিও তার ভেতরই নিহিত। কিন্তু এটির মতো আরও অনেক বিষয়েই সরকার নির্বিকার। ফলে স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলটি এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কতটা ধারণ করছে, সে প্রশ্ন উঠবেই।

প্রশ্ন

৩. মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ধরনের সমাজ ও মূল্যবোধের স্বপ্ন আমরা দেখেছি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সংস্কৃতিকে এখন কীভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি? আমাদের কী করা উচিত?

শাহরিয়ার কবির : প্রথমেই বুঝতে হবে যে সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। রাষ্ট্রকে সংস্কৃতির গুরুত্ব বুঝতে হবে। বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ এক শতাংশের কম। এটা বাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন, ফিরতে হবে সেখানে। ধর্মের নামে রাজনীতি এবং ওয়াজের নামে ভিন্ন ধর্ম আর ভিন্ন জীবনধারার অনুসারী মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা নিষিদ্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করতে হবে। এগুলো ছাড়া দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।