কাউকে দেখলেই তার দিকে তেড়ে যাচ্ছেন সোমা আক্তার। বলছেন, ‘তুই খারাপ, তুই আমার মোবাইল চুরি করছোস, খাবার দিস নাই, তোরে পুলিশে দিমু।’ থুতু দেওয়ার ভয়ও দেখাচ্ছেন। সোমার স্বামী হারুন-অর রশিদ তাঁর কাছে গেলেই দু-চারটা চড়থাপ্পড় মারছেন। পাশ থেকে সোমার বৃদ্ধ মা তাঁর নাকে মেয়ের দেওয়া খামচির দাগ দেখিয়ে বলেন, ‘সারাক্ষণ জানের ভয়ে থাকতে হয়, নিজের পেটের মাইয়্যা, ফালাইয়্যা তো দিতে পারি না।’
এই সোমা সম্প্রতি ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন নারী শ্রমিক হিসেবে। ৬ এপ্রিল দুপুরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সোমা কিছুক্ষণ উদাসভাবে হাসপাতালের বিছানায় বসে ছিলেন, একটু পরেই বিছানা থেকে নেমে হাঁটা দিচ্ছিলেন। আর খেপে গেলে গালাগালি ও স্বামীকে মারধর করছিলেন। সোমার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২ এপ্রিল সৌদি আরব থেকে ফেরত আসেন সোমা। এরপর থেকে আপন মনেই কথা বলছেন অথবা হাসছেন।
সোমা আক্তারের স্বামী হারুন–অর রশিদ রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি কাপড় কিনে তা বিক্রি করেন। ভেবেছিলেন স্ত্রী টাকা পাঠালে কাপড়ের ব্যবসাটা একটু বড় করবেন। হাসপাতালে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, ‘স্ত্রীকে বিদেশ পাঠিয়ে লাভের লাভ কিছুই হইলো না। উল্টো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তাঁর অবস্থা শোচনীয়।’ গত বছরের মে মাসে সোমা বৈধ শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন।
হারুন–অর রশিদ জানান, দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অল্প বয়সে। ছেলের বয়স ১৪ বছর, আর ছোট মেয়ের বয়স মাত্র ৭ বছর। প্রায় এক লাখ টাকা ঋণ ছিল, এখনো ৩৫ হাজার টাকা পরিশোধ করার বাকি আছে।
সোমা আক্তার এর আগে লেবাননে ১৬ মাস এবং জর্ডানে ১২ মাস থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। এবার ফিরলেন এক বছরের মাথায়। আগে যে টাকা পাঠিয়েছেন বা এবার যাওয়ার পর প্রথম দিকে যে টাকা পাঠিয়েছেন, তা দেশে থাকা স্বামী-সন্তানদের নিজেদের খাওয়াসহ সংসারের নানা খরচে ব্যয় হয়ে গেছে। সঞ্চয় বলতে কিছু করা হয়নি।
১৬ হাজার টাকা বেতনে এবার গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন সোমা। দুবার মালিক পরিবর্তন হয়েছে। আগেও টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, তাঁকে মারধর করা হয় আর বেশির ভাগ সময় মাথায় মারেন মালিক।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য বলছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৮১৯ জন নারী শ্রমিক ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়। আর ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফেরা নারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯। সৌদি আরবে বেশিসংখ্যক নারী শ্রমিক যাচ্ছেন বলে এ দেশটি থেকেই বেশিসংখ্যক ফেরত এসেছেন। তবে মোট কতজন নারী মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফিরেছেন, সে বিষয়ে সরকারি কোনো তথ্য নেই।
নারী শ্রমিকদের সৌদি আরবে পাঠানো হয় দুই বছর চুক্তিতে। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিক ফেরত এলে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই দেশের মালিককে আরেকজন নারী শ্রমিক পাঠাতে হয়। তা না হলে নারী শ্রমিক নেওয়ার জন্য মালিক যে টাকা দিয়েছিলেন, তা পরিশোধ করতে হয়। ফলে নারী শ্রমিকেরা কোনো বিপদে পড়লে তখন আর রিক্রুটিং এজেন্সিকে পাশে পাওয়া যায় না। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের জন্য শেল্টার হোম বা তেমন কোনো পুনর্বাসন উদ্যোগ নেই।
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন নির্যাতন সহ্য করতে করতে একসময় নারীরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। এসব নারী শ্রমিক ফেরত এলে তাঁর পরিবারে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে।
দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। গত বছর প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৫ শতাংশ নারী শ্রমিক শারীরিকভাবে অসুস্থ, ২৯ শতাংশের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে, ৮৫ শতাংশ নারী শ্রমিক মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় দিন পার করছেন। ৮৭ শতাংশ শ্রমিক মানসিক অসুস্থতার কোনো চিকিৎসা পাননি। এই নারীরা সামাজিকভাবেও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। চট্টগ্রাম, যশোর ও ফরিদপুরের ৩২৩ জন ফেরত আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়েছিল সংস্থাটি। জরিপ বলছে, ৬১ শতাংশ নারী বিদেশে খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন, ৭ শতাংশ যৌন এবং ৩৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এদিকে অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ফেরত আসা নারী শ্রমিককে দেখভালের দায়িয়ত্ব স্বামী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিতে চাইছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা বা ভাইকে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। ফলে চিকিৎসা, বাড়তি একজনের খাবারের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে পরিবারগুলো হিমশিম খাচ্ছে। বিলসের জরিপেও এসেছে, বিদেশ থেকে ফিরে আসা ১৫ শতাংশ নারী তালাকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ১১ শতাংশ নারী শ্রমিকের স্বামী তাঁদের ছেড়ে চলে গেছেন এবং ২৮ শতাংশ নারী শ্রমিক তাঁদের দাম্পত্য জীবনে বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছেন।
মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সৌদি আরব থেকে গত ৩০ মার্চ দেশে ফেরা সাথীর ঠাঁই হয়েছে রাজমিস্ত্রির কাজ করা বড় ভাই রুহুল আমিন হাওলাদারের বাড়িতে। সাথী সৌদি আরবে ছিলেন চার বছর। নবম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ে সাথীর স্বামীর সঙ্গে নরসিংদী থাকে। আর চিকিৎসার জন্য সাথীকে বরিশালে ভাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বিদেশ থেকে মাসে ২০ হাজার করে টাকা পাঠাতেন স্বামীর কাছে। একটি পাকা বাড়ির অর্ধেক কাজ করেছিলেন, দেশে ফিরে বাড়ির কাজ শেষ করতে চেয়েছিলেন।
মুঠোফোনে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ঢাকার বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় থানায় ফোন করে সাথীর দেশে ফেরার খবর জানানো হয়। পরে থানা থেকে তাঁকে ফোন করে জানালে বিমানবন্দরে গিয়ে বোনকে বাড়িতে আনেন। সাথীকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হয়। হাত-পা ছুড়ে লোকজনকে মারতে যান। এই ভালো এই মন্দ। হাসপাতালে ভর্তি করলে সাথীর সঙ্গে একজনকে থাকতে হবে, খরচের ধাক্কাও আছে। তাই ভর্তি না করে প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসককে দেখিয়ে আনতে হচ্ছে।
নরসিংদীতে বেতের কাজ করা এক ভাই দেশে ফেরার পর কয়েক মাস বোনকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। অবিবাহিত বোনটি ১৪ মাসের মাথায় শুধু মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ফিরেছেন তা–ই নয়, সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন এক সন্তানসহ। বোনকে দেখবেন না বাচ্চাকে, তাই বাচ্চাকে দত্তক দিয়েছেন একজনের কাছে। গত এক বছর ধরেই এই ভাইসহ অন্য ভাইবোনেরা এ বোনের জন্য নিজেদের সাধ্যমতো করছেন।
মুঠোফোনে এই ভাই বলেন, সৌদি আরবে যাওয়ার পর কয়েক মাস ভালো ছিল বোন। তারপর বোন সে দেশে জেলও খেটেছেন। আপাতত বোনের পায়ের শিকল খুলে দিয়েছেন, তবে আবার যে অবস্থা খারাপ হবে না বা শিকল পরাতে হবে না, তা তিনি নিশ্চিত নন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘বোন দেশে গার্মেন্টসে কাজ করত, সুস্থ ছিল। আর ফিরল পাগল হয়ে। ভালো করে চিকিৎসাও করাইতে পারি না। বাচ্চা নিয়া ফেরত আসছে বলে এলাকার মানুষ প্রথম দিকে খারাপ কথা বলত। বোনের অবস্থা এত খারাপ যে এখন মানুষও মায়া করে।’
বিদেশে নির্যাতনের শিকার হওয়া কর্মীর তথ্যসহ তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে কত কর্মী গেছেন, কতজন স্বেচ্ছায় বা সরকারের সহযোগিতায় ফিরে এসেছেন, কতজন বিদেশে অবস্থান করছেন এবং শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়া কর্মীর তথ্যসহ তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে একটি রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩১ জুলাই হাইকোর্ট প্রবাসীকল্যাণ সচিব, পররাষ্ট্রসচিব, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বায়রার সভাপতি-সেক্রেটারিকে হলফনামা আকারে আলাদাভাবে ওই সব তথ্যসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন।
জনস্বার্থে রিটটি করেছিলেন জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিট মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।
বিদেশগামী এবং বিদেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীদের জন্য সাময়িক আবাসস্থল তৈরি করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। চলতি বছরের ১৮ মার্চ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার নামের এ কেন্দ্র চালু করা হয়। নারী কর্মীরা সেখানে স্বল্প মূল্যে থাকা–খাওয়াসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন। তবে তা সাময়িক সময়ের জন্য।
মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় যেসব নারী ফিরছেন তাঁদের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি কর্মসূচি হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে ফেরত আসা কর্মীদের কার কী প্রয়োজন, সেভাবে আলাদা করে সরকারের কোনো কর্মসূচি বা কৌশল নেই। দেশে সার্বিকভাবেই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলিত। বিদেশ থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ফেরত আসাদের বেলায় এটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
শরিফুলের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ১০ লাখ নারী বিদেশে কাজ করছেন। করোনাকালেই অন্তত ৫০ হাজার নারী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে ফেরত আসা নারীদের কাউন্সেলিং ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হয় বলে মনে করেন তিনি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যে নারীরা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ফেরত আসছেন, ব্র্যাকের মাধ্যমে তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে নারীরা বিদেশ যাওয়ার আগেই ওই দেশটির ভাষা, খাদ্যাভ্যাসসহ সার্বিক ধারণা নিয়ে গেলে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কীভাবে ভালো থাকবেন, মানিয়ে চলবেন অর্থাৎ তাঁদের মানসিক সক্ষমতা বাড়িয়ে পাঠানো গেলে এ সমস্যাটা কমে আসবে। এ বিষয়ে সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।