সংসারের খরচ কমানোর চেষ্টায় নিম্ন আয়ের মানুষ

দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ জেলার একটি দিনাজপুর। নিত্যপণ্যের চড়া দামে সংকটে আছে এ জেলার মানুষ।

দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দারিদ্রে্যর হার দিনাজপুরে। জেলাটির ৬৪.৩% মানুষ দরিদ্র।

সূত্র: বিবিএস-২০১৬

দুপুর ১২টা! কিছুটা নির্দয় হয়েছে রোদের তাপ। দেড় শতাধিক মানুষ সেই প্রখর রোদ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছেন খাদ্যপণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের পেছনে। তাঁদের কেউ কেউ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের ওপর। যেন অযাচিত কেউ লাইনে ঢুকে না পড়েন। এরই মধ্যে ভিড় ঠেলে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন আফরোজা আক্তার। গাল বেয়ে নেমে আসা ঘামগুলো চালান করে দিলেন শাড়ির আঁচলে। ‘আপা, কী কিনলেন?’ জিজ্ঞাসা করতেই ঈষৎ হাসি দিয়ে বললেন, ‘দুই কেজি সয়াবিন তেল, দুই কেজি ডাল।’

মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। তারপর যা থাকে, তা দিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি। না খাওয়া হয় দুধ–ডিম, না মাছ-মাংস, ফলমূল। প্রতিদিন ৮০-১০০ টাকা যায় কাঁচাবাজারের পেছনে। এক তরকারিতেই ভাত খেতে হচ্ছে
দিনাজপুর বালুবাড়ি এলাকার মো. মিলন

গত শুক্রবার দুপুরে দিনাজপুর সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চত্বরে এই দৃশ্য দেখা গেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য কিনতে আফরোজার মতো অনেকেই এসেছেন। ইউপি সচিব মাসুদা পারভীন জানালেন, ইউনিয়নে করোনার সময় আড়াই হাজার টাকা সরকারি প্রণোদনা পেয়েছেন, এমন ৬৩০ জন এবং আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় আরও ২ হাজার ৯২৮ জনকে কয়েক দফায় টিসিবির পণ্য দেওয়া হবে।

টিসিবির পণ্য নিতে আসা আফরোজা পণ্য কিনে খুশি হলেও মুহূর্তেই কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। শনিবার সকালে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি ১ হাজার ১০০ টাকা দিতে হবে। টাকা জমিয়েও রেখেছেন। সেখান থেকে ৪৬০ টাকা বের করে তেল-ডাল কিনতে হয়েছে তাঁকে। শনিবার সকালের মধ্যে স্বামী ওই টাকা জোগাড় করতে না পারলে কারও কাছে হাত পাততে হবে। আফরোজা বললেন, সময়মতো কিস্তি দিতেই হবে। এটা মানসম্মানের ব্যাপার।

আফরোজার স্বামী ভ্যানচালক কাইয়ুম ইউপি চত্বরের বাইরে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সংসারে তাঁদের দুই মেয়ে। তিনি বললেন, পরিবারে মাসে ৬০ কেজি চাল, ৫ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি ডাল, ২ কেজি চিনি, ৪ কেজি পেঁয়াজ লাগে। ডিম ও মাছ খাওয়া হয় মাঝেমধ্যে। এ ছাড়া আলু, কুমড়া, কপি, কচুতেই সংসারের রান্না চলে তাঁদের। সাম্প্রতিক সময়ে খরচ কমিয়েছেন তেলসহ অন্যান্য পণ্যের।

ফাজিলপুর ইউপির পাশে রানীগঞ্জ বাজারে মুদিখানায় চাল (বিআর-২৮) প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭৫, পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৪০, চিনি প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেল। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রায় তিন মাস ধরে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। মুদিদোকানদার সোহেল রানা বলেন, ৩ মাস আগেও সয়াবিন তেল বিক্রি করেছেন প্রতি লিটার ১৪২ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ৬৮-৭০ ও বিআর–২৮ চাল বিক্রি করেছেন ৪৮-৫০ টাকায়। এখন সেখানে প্রতিটি পণ্যের গায়ে ৭-১২ টাকার বেশি যোগ হয়েছে।

পরিবারে মাসে ৬০ কেজি চাল, ৫ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি ডাল, ২ কেজি চিনি, ৪ কেজি পেঁয়াজ লাগে। ডিম ও মাছ খাওয়া হয় মাঝেমধ্যে। এ ছাড়া আলু, কুমড়া, কপি, কচুতেই সংসারের রান্না চলে তাঁদের। সাম্প্রতিক সময়ে খরচ কমিয়েছেন তেলসহ অন্যান্য পণ্যের।
ভ্যানচালক কাইয়ুম

গত দুই বছরের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে বেড়েছে, তা জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব দেখলেই বোঝা যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দিনাজপুরে বোরো (সরু) চালের খুচরা দর ছিল প্রতি কেজি ৪২-৪৮ টাকা, বোরো (মাঝারি) ৩৪-৩৮ টাকা। খোলা আটা প্রতি কেজি ২৮-৩০ টাকা, খোলা ময়দা ৩৬-৩৮, মসুর ডাল ৫৬-৬০, খোলা সয়াবিন তেল দাম প্রতি লিটার ৯২-৯৪, ডিম প্রতি হালি ২৪-২৮ টাকা।

গতকাল রোববার পর্যন্ত অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বাজারে বোরো (সরু) চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৮-৬৪, বোরো (মাঝারি) চাল ৫০-৫৬ টাকায়। খোলা আটার দাম প্রতি কেজি ৩২-৩৫ টাকা, খোলা ময়দা ৪৪-৪৮, মসুর ডাল ৯৫-১০০, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৪৪-১৪৬, ডিম প্রতি হালি ৩৪-৩৬ টাকা।

ঢাকায় কনকর্ড নামের একটি কোম্পানিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন ফরিদুল ইসলাম (৩৮)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনায় আক্রান্ত হলে দিনাজপুর সদরের দক্ষিণ কোতোয়ালিতে নিজ বাড়িতে আসেন। তিন মাস রোগে ভুগে এলাকায় আবার রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন। রোজ হাজিরা হিসেবে পান ৪৫০-৫০০ টাকা। তা–ও কোনো কোনো দিন কাজ জোটে না। ফরিদুল জানান, দৈনিক ৩০০-৩৫০ টাকার খরচ লাগে বাড়িতে। দুই মেয়ের স্কুলে যাতায়াত, পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচ জোগাতে পারছেন না। হঠাৎ পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ওষুধ কিনবেন, এমন অবস্থাও নেই। মাসে সাড়ে চার লিটার সয়াবিন তেল কিনতে হতো। সেখানে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত তিন লিটারের মতো কিনেছেন। সব দিক থেকে খরচ কমানোর চেষ্টা করছেন।

একে তো করোনা অতিমারি, তার ওপর যোগ হয়েছে দারিদ্র্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১০টি দরিদ্র জেলার মধ্যে রয়েছে দিনাজপুর। ২০১০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ জেলায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৭ শতাংশ। সেখানে এখন ৬৪ শতাংশের বেশি।

প্রায় একই কথা বললেন দিনাজপুর বালুবাড়ি এলাকার মো. মিলন। শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসে চাকরি করে মাসে বেতন পান ১০ হাজার টাকা। দুই ছেলে পড়ালেখা করছে। স্ত্রী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মিলন বলেন, ‘মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। তারপর যা থাকে, তা দিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি। না খাওয়া হয় দুধ–ডিম, না মাছ-মাংস, ফলমূল। প্রতিদিন ৮০-১০০ টাকা যায় কাঁচাবাজারের পেছনে। এক তরকারিতেই ভাত খেতে হচ্ছে।’ করোনাকালে পৌরসভা থেকে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি আলু পেয়েছিলেন। এ ছাড়া কোনো সহযোগিতা পাননি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের ঘরে ঘরে আজ ‘মঙ্গা’ পরিস্থিতি চলছে বলে মন্তব্য করলেন মিলন।