কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি আইনি বৈধতা পেয়েছে। বুধবার এ-সংক্রান্ত ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীন ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল, ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর কমিটি তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সময়-সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে। মূলত হেফাজতে ইসলাম যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবেই আইনটি হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলার পর বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম উদ্দিন বিলটি নিয়ে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘মনে হচ্ছে এই আইনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সাধারণ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আছে, এখানে সে ধরনের কিছু নেই। মনে হচ্ছে চাপের মধ্যে বা যেমন খুশি তেমনভাবে এটি করা হয়েছে। এই বিলটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।’
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আইনে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। হয়তো এর কারণ দেওবন্দের কারিকুলাম অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এটি করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষায় মাস্টার্সের কারিকুলামের একটি কমা পরিবর্তন করতেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন লাগে। হয়তো বাস্তবতার কারণেই ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আহ্বান জানান যাতে ভবিষ্যতে কিছু নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তবে তিনি এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।
এ ছাড়া বিরোধী দলের আরও কয়েকজন সদস্যের বিলের ওপর জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।
আইনে বলা হয়েছে, এই আইন সমগ্র বাংলাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসরণে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
বিলে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল জারি করা এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনের আলোকে ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর একটি কমিটি থাকবে। এই কমিটি স্থায়ী কমিটি বলে বিবেচিত হবে এবং তা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে। এই কমিটির নিবন্ধিত মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমান বলে বিবেচিত হবে।
‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে ছয়টি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থাকবে। সেগুলো হলো: বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙা, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ, আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ, তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ ও জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ।
‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর কমিটির মাধ্যমে নিবন্ধিত কওমি মাদ্রাসাগুলোতে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসারে দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষা পরিচালিত হবে।
এর আগে গত বছরের এপ্রিল মাসে দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি দেয় সরকার। এরপর এই স্বীকৃতির আইনি বৈধতা দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ১৩ আগস্ট এই আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১০ সেপ্টেম্বর তা সংসদে তোলা হয়। সর্বশেষ আজ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য সরকার ছয় বছর আগে ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেছিল। সেই কমিশন প্রতিবেদনও দিয়েছিল। তাতে ওই শিক্ষাব্যবস্থার স্বীকৃতির জন্য ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবটি উত্থাপনও করা হয়েছিল। এই কর্তৃপক্ষে সরকারের প্রতিনিধি থাকার কথা ছিল। কিন্তু এসব আর মানা হয়নি।