>ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ
পাবলিক পরীক্ষা আর সেশনে জট লেগেছে
আর্থিক সংকটে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সংকটে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আরও অন্তত চার মাস করোনাবন্ধ জারি থাকার আশঙ্কায় প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী অত্যন্ত ঝুঁকিতে পড়েছে। দেড় মাস ধরে চলা এই বন্ধে ইতিমধ্যেই তাদের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত। পাবলিক পরীক্ষা আটকে গেছে। সেশনজট বাড়ছে। বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো পড়ছে আর্থিক সংকটে।
নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের স্কুল, কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। আগামী ৫ মে করোনাজনিত সাধারণ ছুটি ওঠার কথা। কিন্তু শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী রমজান, ঈদুল ফিতরসহ নানা উপলক্ষে ৩০ মে পর্যন্ত স্কুল-কলেজের ছুটি। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটা বলেছেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এই বন্ধ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকবে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা আর সেশনজটের ওপর ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকার প্রভাব এখনই পড়তে শুরু করেছে। আবার শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি–নির্ভর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। আরও কয়েক মাস বন্ধ থাকলে যে শিক্ষকদের বেতনে সরকারের অনুদান নেই (নন-এমপিও), তাঁদের বেতন, এমনকি চাকরিও ঝুঁকিতে পড়তে পারে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে শুরু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন ঝুঁকির কথা বলছে।
শিক্ষাবিদেরা তাই দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে সেগুলো যথার্থ কার্যকর করার তাগিদ দিচ্ছেন। করোনাকালে শিক্ষাব্যবস্থার সংকটও বিশ্বজোড়া। অনেক দেশই এখন পুরোপুরি অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পাশের দেশ ভারতে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন তেমনটা করছে।
বাংলাদেশ সরকার গত ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের ক্লাস রেকর্ড করে সংসদ টিভিতে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। তবে ঘরে বসে টিভি দেখে ক্লাস অনুসরণ করার সুযোগ সব শিক্ষার্থীর নেই। এ ব্যবস্থায় শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে বুঝে নেওয়া যায় না।
হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে বা ওয়াটসঅ্যাপের মতো মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দিচ্ছে। তবে পরীক্ষা কেউই নিতে পারছে না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংকট কমানোর একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় হয়তো ছাড় দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপরের ক্লাসে ওঠানো যাবে। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে করণীয় ভাবতে হবে। তাঁর মতে, জেএসসির মতো এক বছর মেয়াদি কোর্সগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি হবে।
এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ফল বেরোয়। এবারের ফল আসার কথা ছিল আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে। এটা যত পেছাবে, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিও ততটা পিছিয়ে যাবে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয় এপ্রিলের শুরুতে। কিন্তু এবার সেটা স্থগিত হয়েছে। ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তিও পিছিয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস-পরীক্ষা টানা বন্ধ। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা নিতে না পারলে সেশন আটকে যাবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টিভিতে ক্লাসের পাশাপাশি তাঁরা অন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন। সামনে নিয়মিত ছুটিগুলো কমতে পারে। পরীক্ষার বিষয়েও আলোচনা করে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইতিমধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। একাদশ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে ওঠার পরীক্ষা হয়নি। জুনে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফওজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সবার আগে জীবন। তাঁরা আশা করছেন, মন্ত্রণালয় ক্লাস-পরীক্ষার ব্যাপারে যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত দেবে।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান বুরোর তথ্য বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ে প্রায় পোনে দুই কোটি ছেলেমেয়ে। এনজিও পরিচালিত আর কিন্ডারগার্টেনসহ স্কুল আছে সোয়া লাখের কিছু বেশি। অর্ধেকই সরকারি স্কুল।
মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সোয়া কোটির কিছু বেশি। স্কুল আছে ২১ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে সরকারি স্কুল মাত্র ৬৭৫টি। কলেজ আছে মোট সাড়ে চার হাজারের মতো, বেসরকারিই বেশি। মোট শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধ কোটি।
দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৫১টি, দুই-তৃতীয়াংশই বেসরকারি। মোট শিক্ষার্থী ১২ লাখের কাছাকাছি। আলিয়া মাদ্রাসা, কারিগরি, ইংরেজি মাধ্যমসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে ৫০ লাখের কাছাকাছি ছেলেমেয়ে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান জানান, দেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রায় ৪০ হাজার। প্রতিষ্ঠানগুলো চলে মূলত শিক্ষার্থীদের বেতনসহ ফির টাকায়। এখন শিক্ষকদের বেতন আর বাড়িভাড়া দিতে কষ্ট হচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরীর আশা করছেন, সেপ্টেম্বরের আগেই করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমবে। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখনই বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। নানামুখী বিকল্প ব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।