৩১ ডিসেম্বর ২০১৯। গোটা বিশ্ব ব্যস্ত বিদায় দিতে একটি দশককে। হঠাৎ বিকেলের দিকে চীন সরকার ঘোষণা দিল, দক্ষিণ চীনের উহান শহরে দেখা দিয়েছে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ। আক্রান্ত হচ্ছেন অনেক মানুষ। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না কী জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছিল শ্বাসতন্ত্রের এই রোগ।
১০ মাস পেরিয়ে গেছে চীনের সেই ঘোষণার। আমরা এখন জানি, নিউমোনিয়ার মতো সেই অসুস্থতার নাম কোভিড-১৯, যা হয়ে থাকে করোনাভাইরাস দ্বারা। কোভিড-১৯ ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ কোটি ৭৯ লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ১২ লাখ ২১ হাজারের বেশি।
আমরা অতিক্রম করছি একটি ক্রান্তিলগ্ন, যেখানে আমরা সবাই যোদ্ধা, আমরা নিজেদের মতো করে সবাই এই যুদ্ধে জয়ী হতে চাই, চাই কোভিডমুক্ত একটি বাংলাদেশ, চাই কোভিডমুক্ত একটি পৃথিবী। সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে চলছেন আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিক গবেষকেরা। আমাদের দেশ গত ১০ মাসে প্রাণিবিষয়ক গবেষণায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু এখন আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা আমাদের এই সাফল্য বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য বজায় রাখব।
মার্চের ৮ তারিখে বাংলাদেশে যখন প্রথম তিনজন কোভিড রোগী শনাক্ত হলো, তখন মাত্র একটি ল্যাবরেটরি ছিল গোটা দেশের পরীক্ষার জন্য। মার্চ মাস শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু ল্যাব (সরকারি ও বেসরকারি) যুক্ত করা হয় পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে। আজ আমাদের দেশব্যাপী ১১১টি ল্যাব কোভিড-১৯ রোগীদের পরীক্ষা করে যাচ্ছে। বিষয়টি সত্যিকার অর্থে অকল্পনীয়।
কোভিড-১৯ শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হলো আরটি-পিসিআর। এই পরীক্ষা কিন্তু খুব সাধারণ কোনো পরীক্ষা নয়। প্রশিক্ষিত ল্যাবরেটরি কর্মীর পাশাপাশি প্রয়োজন হয় অনেক ধরনের কিট ও ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম এবং উচ্চমানের পিসিআর মেশিন। এ ছাড়া ফলাফলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ল্যাবরেটরি গবেষকদের বিশ্লেষণ করতে হয়। যে দেশে পিসিআর পরীক্ষা হতো হাতে গোনা কিছু ল্যাবরেটরিতে, সেই দেশে এখন শতাধিক ল্যাবে এই পরীক্ষা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
প্রথম দিকে যদিও বেশ কিছু বাধা পেরোতে হয়েছে পরীক্ষার গুণাগুণ নিয়ে, কিন্তু আস্তে আস্তে সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কিছু মানসম্মত ল্যাবরেটরি একসঙ্গে দেশের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিকে নিরীক্ষণ করছে। বাংলাদেশে যে শুধু পরীক্ষাই হচ্ছে, তা নয়। এর বাইরে আমরা করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করছি, যা আমাদের জীবাণুর ওপর সম্ভাব্য ভ্যাকসিনগুলো কাজ করবে কি না, তা নিশ্চিত করবে। সাধারণত আমরা অন্য সব নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মতোই, জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য আমাদের নমুনাগুলো পাঠিয়ে দিই সমৃদ্ধ দেশগুলোর বিজ্ঞানীদের কাছে। তাঁরাই নমুনাগুলোর সিকোয়েন্সিং ও ডেটা বিশ্লেষণ করে থাকেন। তবে কোভিড-১৯-এর সময় ধনী দেশগুলো তাদের নিজস্ব রোগী ও নমুনা নিয়েই ব্যস্ত। এটা যেমন আমাদের চিন্তিত করেছে, তেমনি এটাও জানিয়ে দিল যে এ দেশে করোনাভাইরাসকে পরাজিত করার উদ্যোগ আমাদের একাই নিতে হবে।
একটিমাত্র সিকোয়েন্সিংয়ের পরই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষক দল তৎক্ষণিকভাবে করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের প্রচেষ্টায় যোগ দেয় এবং বর্তমানে কমপক্ষে ছয়টি দল সিকোয়েন্সিং করছে।
১২ মে প্রথম এক বাংলাদেশির কাছ থেকে প্রাপ্ত করোনাভাইরাসের সিকোয়েন্সিং করা হয়। ব্যাপারটা অবশ্যই অনেক গর্বের যে বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এক বাংলাদেশির ভাইরাসকে সিকোয়েন্সিং করছেন। কিন্তু তার থেকেও অনেক গর্বের বিষয় হচ্ছে এর পরের ঘটনাগুলো। একটিমাত্র সিকোয়েন্সিংয়ের পরই বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষক দল তাৎক্ষণিকভাবে করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের প্রচেষ্টায় যোগ দেয় এবং বর্তমানে কমপক্ষে ছয়টি দল সিকোয়েন্সিং করছে। এই দলগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই এর আগে কখনো আরএনএ ভাইরাস সিকোয়েন্সিং করেনি।
আরএনএ সিকোয়েন্সিং সাধারণ ডিএনএ সিকোয়েন্সিং থেকে আলাদা এবং বেশ জটিল। কিন্তু তা আমাদের আটকায়নি। আজ অবধি বাংলাদেশে সিকোয়েন্সিং হয়েছে তিন শতাধিক ভাইরাস এবং ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন বায়ো-ইনফরমেটিক গবেষকেরা। বায়ো-ইনফরমেটিশিয়ানরা অনবরত সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করছেন এবং ক্রমাগত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন।
এগুলোর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশেই করোনাভাইরাসের টিকার ডিজাইন ও উৎপাদন করার অকল্পনীয় উদ্যোগ। বাংলাদেশি একটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছে এবং শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। গত কয়েক দশকে আর এমন প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। কোভিড-১৯ নতুন উৎসাহ জাগিয়েছে বিশেষজ্ঞদের মনে।
কোভিড-১৯-এর যা–ই হোক না হোক, আমাদের সঙ্গে থেকে যাবে টাইফয়েড, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা যক্ষ্মার মতো রোগগুলো। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে যে এটাই শেষ মহামারি নয়। কোভিড-১৯ আমাদের যে প্রশিক্ষণগুলো দিল, এগুলো মনে রাখতে হবে, ব্যবহার করতে হবে।
গত ১০ মাসে আমরা অংশীদার হয়েছি এবং দেখেছি অতুলনীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার উচ্ছ্বাস। আজ হোক, কাল হোক, আগামী বছর হোক, করোনাভাইরাস হারবেই, কিন্তু আমরা কোনোভাবেই হারাতে পারব না এই উদ্যম ও কর্মচাঞ্চল্য। কারণ, এখনো অনেক কাজ বাকি, অনেক রোগ বাকি, যাদের দমন করার দায়িত্বও আমাদের বাংলাদেশি গবেষকদের।
কোভিড-১৯-এর যা–ই হোক না হোক, আমাদের সঙ্গে থেকে যাবে টাইফয়েড, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা যক্ষ্মার মতো রোগগুলো। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে যে এটাই শেষ মহামারি নয়। কোভিড-১৯ আমাদের যে প্রশিক্ষণগুলো দিল, এগুলো মনে রাখতে হবে, ব্যবহার করতে হবে। আরটি-পিসিআর ল্যাবগুলোতে শিক্ষাপ্রাপ্ত যাঁরা এখন নিয়মিত কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করে যাচ্ছেন, সেগুলোকে চলমান রাখতে হবে। মেশিনে জং ধরতে দেওয়া যাবে না। কোভিড-১৯-এর পরও রোগনির্ণয় জারি রাখতে হবে। সিকোয়েন্সিং মেশিনগুলো ব্যবহার করতে হবে অন্যান্য জীবাণুর সিকোয়েন্সিং করার জন্য, সেটা হোক ডেঙ্গু ভাইরাস বা যক্ষ্মার জীবাণু। টিকিয়ে রাখতে হবে সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণের উৎসাহ, টিকা উৎপাদনের প্রত্যাশা। কলেজ-ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এই প্রশিক্ষণগুলো।
আমরা প্রমাণ করেছি যে আমরা সক্ষম। আমাদের এই শক্তি, এই অনুপ্রেরণা ও এই উচ্ছ্বাস বজায় রাখতে হবে, অতিক্রম করতে হবে সামনের দীর্ঘ পথ।
● ড. সেঁজুতি সাহা, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের জিন-নকশা উন্মোচনের নেতৃত্বদানকারী অণুজীববিজ্ঞানী । চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী