শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের ভয়ে থাকতে হয়: জি এইচ হাবীব

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জি এইচ হাবীব। শিক্ষকদের অবমাননার প্রতিবাদে গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে ‘আমিও স্বপন কুমার বিশ্বাস’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য একাই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোশাররফ শাহ।

ক্যাপশন: অধ্যাপক জি এইচ হাবীব
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

প্রথম আলো: কান ধরে ওঠবস করানো, পাঠদানের জন্য কারাগারে পাঠানো, গলায় জুতার মালা—শিক্ষকদের সঙ্গে একের পর এক অবমাননাকর ঘটনা ঘটে চলছে। একজন শিক্ষক হিসেবে ঘটনাগুলো কীভাবে দেখছেন?

জি এইচ হাবীব: খুব ভীতিকর ঘটনাগুলো। আর শুধু যে শিক্ষকদের ওপর হচ্ছে, এমন নয়। বাংলাদেশের নানা শ্রেণি–পেশার লোকের ওপর এমনটা হচ্ছে। এর মধ্যে শিক্ষক সহজ টার্গেট। ধরুন, কোনো ডাক্তারের ওপর এমন ঘটনা হলো বা অন্য কোনো পেশার লোকের ওপর হলো, তাঁরা যদি প্রতিবাদ করেন বা তাঁদের সেবা বন্ধ করে দেন, দেখবেন এটার খুব বড় প্রভাব জনসাধারণের ওপর পড়ে। কিন্তু শিক্ষকেরা যদি বলেন, ‘ক্লাসে যাব না, পড়াব না,’ তাহলে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, পড়াশোনার বিষয়ে সচেতনতা নেই। এই যে করোনার সময় তো ক্লাস বন্ধ ছিল। লোকজনের কি খুব একটা অসুবিধা হয়েছে? কারণ কী? কারণ, লোকজনের এসব নিয়ে মাথাব্যথা কম। অল্প কিছু লোক রয়েছেন, যাঁরা এসব বিষয়ে সচেতন।

আবার এই যে বাংলাদেশে এত মানুষ। খুব কিন্তু দক্ষ লোকজন নেই। কিন্তু সেটা নিয়ে যতটা না কথা আসে, শিক্ষকদের নানা দুর্বলতা নিয়ে হরহামেশাই কথা আসে। আমি বলছি না, আমাদের দোষ নেই। আমাদেরও নানা দোষ আছে। এটা তো এমন নয় যে হঠাৎ শুধু শিক্ষাঙ্গনটা পচে গেছে দেশের। আমাদের তো সর্বাঙ্গে ব্যথা। সব জায়গায় দুর্নীতি, নানা অনিয়ম। কিন্তু সব ছাপিয়ে এখন একটা সহজ টার্গেট হয়ে গেছেন শিক্ষকেরা। কারণ, শিক্ষকদের কোনো এক্সিকিউটিভ পাওয়ার (নির্বাহী ক্ষমতা) নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কেন বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? এই দায় কি সরকার বা প্রশাসন এড়াতে পারে?

জি এইচ হাবীব: না, সেটা তো অবশ্যই পারে না। মূল্যবোধের বিরাট একটা অবক্ষয় তো রয়েছেই। আমাদের বড় এক নিয়ামক হচ্ছে রাজনীতি। কিন্তু সেই রাজনীতিতে এখন করুণ দশা। এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে, সমাজে, এমনকি পরিবারেও। কারণ, রাজনীতির ব্যক্তিরাই আমাদের শিক্ষার নীতিগুলো তৈরি করেন। কিন্তু এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা এখন তৈরি হয়েছে, যেখানে আমরা কোনো প্রশ্ন করতে পারি না। প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করা হয়, যেখানে মুখস্থ বিদ্যার ফল বেশি। ফেসবুকে সামান্য একটু সমালোচনা করলে শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এমনিতে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে, কিন্তু শিক্ষকদের বেলায় এসবের কিছুই লাগে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম। তাঁর বিরুদ্ধে সামান্য ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য মামলা হলো। মামলাটা করল সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক কর্মী। এ মামলায় মাইদুলকে ধরেও নিয়ে যাওয়া হলো, এক মাস জেল খাটতে হলো। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এরপর দেখুন, উৎপল কুমার সরকার নামের এক শিক্ষককে দশম শ্রেণির এক ছাত্র পিটিয়ে মেরে ফেলল। তাকে ধরার কী ব্যবস্থা হলো? পুলিশ কি জানে না, সে কোথায়? সব মিলিয়ে শিক্ষকদের ওপর ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। তাহলে বলুন, এখন কোথায় যাব আমরা? এরপরও আমরা যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছি, তাঁরা কিছু কথা বলি। কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা তো কোনো কথাই বলতে পারেন না।

শিক্ষকদের অবমাননার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে নিয়ে অধ্যাপক জি এইচ হাবীবের অবস্থান
প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি একা দাঁড়ালেন। অন্য শিক্ষকদের কেন পাশে পেলেন না?

জি এইচ হাবীব: ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েক দিন আগে। আমি ছুটিতে ছিলাম। ছুটি থেকে আসার পর ওই দিন সকালে মনে হলো, কিছু একটা করা দরকার। পরে কয়েকজনকে ফোন করলাম। কেউ ঘুমাচ্ছিলেন, আবার কেউ অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আসতে পারেননি। আগে থেকে আয়োজন থাকলে আরও কয়েকজনকে পেতাম। তবে সে সংখ্যা কম। এর আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন গন্ডগোল হলো, তখন আগে থেকে আয়োজন ছিল। কিন্তু সেখানেও পাঁচ-ছয়জনের বেশি পাইনি। আমি যখন দাঁড়িয়েছি, তখন কিছু শিক্ষক আমাকে দেখেছেন। এরপর চলে গেছেন। হয়তো তাঁরা বুঝতে পারেননি, আমি কেন দাঁড়িয়েছি, অথবা বুঝেও চলে গেছেন। একটা ভয়ের সংস্কৃতি এখানে তৈরি হয়েছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখানে ভয়ের সংস্কৃতি বলতে আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

জি এইচ হাবীব: একজন অন্য পেশার লোকের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা সহজ। ওই যে মাইদুলের কথা বললাম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেটা আছে, সেটা তো একটা মারাত্মক ব্যাপার। সেটা নিয়ে আমরা কথা বলছি। এখন কেউ একটা কথা বললে আগেপিছে দশবার ভাবেন, তারপর বলেন। আমি যে দাঁড়িয়েছি, সেখানেও আমার প্রিয়জনেরা বলেছেন, ‘আপনি যে দাঁড়িয়েছেন সেটা ভালো, কিন্তু আপনাকে নিয়ে ভয় লাগে।’

প্রশ্ন

প্রথম আলো: শিক্ষকদের সঙ্গে অবমাননাকর আচরণের কারণে শ্রেণি কার্যক্রমে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন? আপনি নিজে এখন কি শ্রেণিকক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

জি এইচ হাবীব: আমি ক্লাসে সাহিত্য পড়াই। পড়াতে গিয়ে নানা ধরনের কথা বলতে হয়। এখন ধরুন, আমি ফেমিনিজম পড়াচ্ছি, এখানে আমাকে নানান ধরনের কথাবার্তা বলতে হয়, ভয়ে থাকতে হয়৷ আবার যাঁরা বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন, যাঁরা ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব পড়াচ্ছেন বা এমন কিছু পড়াচ্ছেন যা নিয়ে সমস্যা হতে পারে বলে আন্দাজ করতে পারেন, তাঁরা তো খুবই সাবধানে কথা বলবেন। ফলে এটার তো একটা প্রভাব পড়েই শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীরা যখন যা খুশি করে ফেলতে পারেন, এ ভয়ও থাকে শিক্ষকদের মধ্যে। আমরা দেখেছি, ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট নকল করে পোস্ট দিয়ে একটা কিছু করে ফেলতে। সুতরাং ক্লাসের মধ্যে এটার একটা বড় প্রভাব পড়বেই। অনেক শিক্ষকই কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। সাবধানে কথা বলবেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গনে এসব ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হতে পারে? উত্তরণের কি উপায় নেই?

জি এইচ হাবীব: প্রভাব তো পড়ছেই। আরও পড়বে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন অন্ধকারে। শিক্ষকদের একটা ভালো গবেষণা করা, একটা ভালো বই লেখা, যেটা আন্তর্জাতিকভাবে সংবর্ধিত হচ্ছে, এমন কিছু তো পাওয়া যাচ্ছে না। বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় আমরা অবদান রাখতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিংয়ের কথা বাদ দেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোনো প্রকাশনা সংস্থা কি রয়েছে, যেখানে কোনো ভালো বই বের হয়? এর থেকে উত্তরণে রাজনীতিই বড় নিয়ামক। রাজনীতিতে সুবাতাস আনতে হবে। প্রশ্ন করতে দিতে হবে। দ্বিমত মেনে নিতে হবে। আপনার সঙ্গে আমি একমত না–ও হতে পারি, তবু বলতে দিতে হবে। কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। মোটকথা প্রশ্ন করার, বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। তাহলেই এ ধরনের ঘটনা থেকে আমরা উত্তরণ পাব।