শেখ হাসিনা এবং ১৫ আগস্টের ছায়া

লেখাটা ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে লেখাটি পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো।

১৭ মে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর জনসভায় শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

>

[১৯৮১ সালে শিল্প–সাহিত্যের পত্রিকা সচিত্র সন্ধানীতে (১৯৫৬–১৯৭১; ১৯৭২–১৯৯০–এর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকাশিত) প্রকাশিত ৪টি লেখা হাতে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতে ফিরে গেলাম সেই সময়ের বেদনাবিধুর ও মর্মান্তিক বঙ্গবন্ধু হত্যাঘটনার পরবর্তী সময়গুলোতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণপ্রিয় কন্যা, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের (১৫ আগস্ট ১৯৭৫) ছয় বছর পরে তাঁর সঙ্গে ঢুকেছিলাম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে। তাঁরই সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখেছি বিধ্বস্ত স্মৃতিধূসর সেই বাড়িটির আনাচ–কানাচ। শেখ হাসিনা, তাঁদের বাড়ির গৃহকর্মী এবং উপস্থিত সাংবাদিকদের কথা শুনেছি।

আমি তখন সচিত্র সন্ধানীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পত্রিকাটির কর্ণধার সম্পাদক প্রয়াত গাজী শাহাবুদ্দিন এবং শিল্পী প্রয়াত কাইয়ুম চৌধুরী চেয়েছিলেন, লেখাগুলো আমিই লিখি। তবে আমার কাছে লেখার দায়িত্বের চেয়েও বেশি ছিল মর্মস্পর্শী সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার উদ্দীপনা। সেসব স্মৃতি এখনো আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।]

এক.

জনস্রোতে শেখ হাসিনা

সেদিন রোববার, ১৭ মে ১৯৮১। রাজপথে নেমেছিল মানুষের ঢল। পথের দুই ধারে মানুষের মিছিল, পথে ট্রাক, গাড়ি, হোন্ডার সারিবদ্ধ শোভাযাত্রা। পথের মানুষ আগেই জানে, শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন পর ঢাকায় আসছেন। বলাবলি চলছিল, ভালোই হয়েছে, রোববার অবসরের দিন, সময়টাও ভালো, বিকেলে শেরেবাংলার জনসভায় যাওয়া যাবে। রিকশাযাত্রীদের কথোপকথনে রিকশাওয়ালাও যোগ দেন, ‘দেইখ্যা আসেন কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট, শেখের বেটির লাগি কাতারে কাতারে মানুষ জমছে সকাল থাইক্যা। শেখ মুজিবুর যেই দিন ফিরছিল যুদ্ধের পর, এমুন মানুষ সেই দিনও হয় নাই।’

সত্যি তাই। তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে পথে দেখেছি, দুই ধারের বাড়ির কার্নিশে, ছাদে, দোকানে, ফুটপাতে মানুষ নির্নিমেষ চেয়ে ছিল ট্রাকগাড়ির শোভাযাত্রার দিকে। বিমানবন্দর এত দূর শহরাঞ্চল থেকে যে মানুষ ট্রাকগাড়ির শরণাপন্ন না হয়ে পারেনি। পথের মোড়ে মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আহাজারি, ‘কী দ্যাখতে আইল শেখের মাইয়া, মা নাই, বাপ নাই, ভাইও নাই। আহা রে ক্যামুনে জানি জাগব ওর পরানে।’ কেঁদেছেন অনেকেই। কণ্ঠে স্লোগানের মর্মবিদারী ভাষা।

বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষমাণ জনতার কোঁচড়ে মুড়ি-চিড়ার স্পষ্ট আভাস দেখা যাচ্ছিল। দূর থেকে যাত্রা করে এঁরা এসেছেন। সবার চোখ রানওয়ের দিকে। আসমানের অবস্থা দুই দিন ধরেই খারাপ যাচ্ছে। কী জানি কেমন যাবে আজকের দিন। কালো মেঘ জমছে। বিমানবন্দর ছেয়ে গেছে গাড়ি আর মানুষে। ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকার গেট, গেটের ওপর ছাদ, লোকে লোকারণ্য। মানুষের চিৎকার, কথা, ঠেলাধাক্কা—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে শেখ হাসিনার আগমনবার্তা।

ফুলের ঝাঁকা হাতে এক স্বেচ্ছাসেবক নিরাপত্তারক্ষীর ব্যূহ ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে না পারায় উত্তেজিত, অথচ এত বড় কাজটির জন্য রোমাঞ্চিতও বটে। শেষে ফুলের ঝাঁকাটি লোকের হাতে হাতে গেটের ওপারে চলে গেল। সেখানে নেতারা অপেক্ষমাণ শেখ হাসিনার বিমানাবতরণের জন্য সাংবাদিক, আলোকচিত্রশিল্পীরা দুর্লভ কথা আর মুহূর্তটিকে কাগজ-কলম-ক্যামেরায় বন্দী করবেন বলে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান দেখেই পুলিশ, আনসারের প্রতিরোধ ভিঙিয়ে জনতা বানের পানির মতো ঢুকে গেল রানওয়েতে। বারকয়েক এমনি আসা–যাওয়ার মধ্যে শেখ হাসিনা এসে নামলেন জনসমুদ্রে। কান্না–হাসির দোল-দোলানো এ কোন মিলনোন্মুখ দৃশ্য।

শত–সহস্র কণ্ঠের অভিবাদন নিতে নিতে, হলুদ ফুলের মালা গলায়, দুই হাত উত্তোলিত করে, বন্ধু-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে শেখ হাসিনা যখন চলে গেলেন বিমানবন্দর ছেড়ে, তখন জনতার পদভারে প্রকম্পিত সমগ্র এলাকাজুড়ে এল হর্ষধ্বনি। শেখ হাসিনার অশ্রু ঝরতে না–ঝরতেই তাঁর প্রতি সমবেদনায় বাংলার প্রান্তরজুড়ে নেমে এল অঝোর বারিধারা।

২৪ মে ১৯৮১, সচিত্র সন্ধানী

দুই.

আমি কেন বেঁচে রইলাম, বলতে পারেন?

আমি কেন বেঁচে রইলাম, বলতে পারেন? সবার সঙ্গে আমিও কেন শেষ হয়ে গেলাম না? বলছিলেন শেখ হাসিনা। বহু কান্না কেঁদেছেন, ১০ দিন ধরে শুধুই মা–বাবা, ভাই, আত্মীয়স্বজনের কথা মনে পড়েছে। জনসংবর্ধনার উষ্ণ আত্মীয়তায় বাবার জন্য শোক আরও বেড়েছে। টুঙ্গিপাড়ায় বাবার কবরের পাশে বারবার সংজ্ঞা হারিয়ে জ্বরতপ্ত শরীরে শেখ হাসিনা কেবল ভেবেছেন, ‘আমি কেন বেঁচে থাকলাম?’ পরক্ষণেই মেয়ে পুতুলকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন অজস্রধারায়। স্বামী ও ছেলে জয়কে এই শোকাকুল অবস্থায় কাছে পেলে হয়তো ভার লাঘব হতো, হয়তো হতো না।

অনেক বর্ষণের পর কিছুটা শান্ত তাঁর দুই চোখে এখন নেমে আসছে ক্লান্তি, অপরিসীম ক্লান্তি। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ঠিকানা জোগাড় করে ২৮ মে ঠিক বেলা একটায় যখন লালমাটিয়ার বাসায় গেলাম, তখন শেখ হাসিনা তৈরি হয়েছেন শেখ মনির নাবালক দুই ছেলে পরশ আর তাপসকে দেখতে যাবেন বলে। তাঁর সোনালি ফ্রেমের চশমার কাচে ঝিলিক দিয়ে উঠেই মিলিয়ে গেল পুরোনো পরিচয়ের ঘনিষ্ঠ হাসি। শেখ হাসিনা স্বামীর চাকরিস্থলে চলে গিয়েছিলেন ১৫ আগস্টের মাত্র কয়েক দিন আগে। জয়কে কিছুতেই নানা শেখ মুজিব ছাড়তে চাননি। কিন্তু শেখ হাসিনাও ছেড়ে যেতে চাননি জয়কে। এমনই টানাপোড়েনের মধ্যে জয়কে নিয়ে পাড়ি জমালেন বিদেশে। ও জন্যই তো জয় বেঁচে গেল। নয়তো শেখ হাসিনার জন্য অপেক্ষা করত আরও মর্মান্তিক শোক।

শেখ হাসিনা বললেন, ‘কত দিন পর দেখা সেই দিনগুলো মনে পড়ে গেল আপনাকে দেখে। কী বলব আর বলুন, আমি কেন বেঁচে রইলাম, বলতে পারেন? সবার সঙ্গে আমিও কেন শেষ হয়ে গেলাম না?’

তিনি আরও বললেন, ‘১৫ আগস্টের পর সবাইকে হারিয়ে আমার সব অনুভূতি মরে গেছে। সব হারানোর পর ঢাকা শহরে এখন শুধু কবর আর কবর। যাদের বুকে মাথা রেখে দুই দণ্ড শান্তি পেতে পারতাম, তাদের আর দেখতে পাব না এই জীবনে, ভাবলেও যে আমার বুক ফেটে যায়। বলেন আমি আর কী বলতে পারি?’

দেশের সর্ববৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ আমার অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া সম্ভব নয় বলে খুব নরম গলায় ক্লান্ত সুরে অনুরোধ জানালেন পরে একবার যেতে। তিনি দেশে ফিরে আসার পর এখনো পার্টির মিটিং হয়নি। দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই তিনি পারবেন সাক্ষাৎকার দিতে।

৩১ মে ১৯৮১, সচিত্র সন্ধানী

তিন.

৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি

ধানমন্ডি লেকের পাড়ে ৩২ নম্বর রোডের মাঝামাঝি এলেই শোনা যায় কোরআনখানির সুমধুর সুর। এই বাড়িটির মালিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংসভাবে সপরিবার নিহত হওয়ার ছয় বছর পর তাঁর জীবিত দুই উত্তরাধিকারীর একজন জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে সরকার থেকে বাড়িটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ছয় বছরে এ বাড়িটি পুলিশি পাহারায় ছিল।

গুলিবিদ্ধ বাড়ির দেয়ালগুলো নতুন করে রং করা হলেও ভেতর এখনো অপরিষ্কার। দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িটি এখন বন্ধ করা আছে, পতাকায় আচ্ছাদিত সিঁড়িটিতে শেখ হাসিনা আকুল হয়ে কেঁদেছেন, ‘বাবা, বাবা গো, তুমি কোথায়?’ এই সিঁড়িতে এখনো বঙ্গবন্ধুর রক্তের চিহ্ন বেশ স্পষ্ট।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিচের যে ঘরে বসতেন, পড়াশোনা করতেন, সে ঘরগুলো খোলা ছিল। এখনো বইয়ের আলমারিতে চাবি ঝুলছে, টেলিফোনটা অকেজো। কিন্তু তাঁর শেষ ছোঁয়ার চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে বই, টেবিল-চেয়ারে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া যে সিঁড়িটি ঘরোয়া কাজে ব্যবহৃত হতো, সেটি দিয়েই এখন ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। আরেকটি কাঠের সিঁড়ি গাড়িবারান্দার কাছ দিয়ে ওপরে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো শেখ হাসিনা ওপরে উঠে সব ঘর দেখার মতো মানসিক শক্তি জোগাড় করে উঠতে পারছেন না।

ইতিমধ্যে এই বাড়িটি দর্শনীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সবাই গভীর দুঃখ নিয়ে দেয়ালে বুলেটবিদ্ধ ছবি, তছনছ করে দেওয়া বাড়ির দরজা-জানালা, ছিন্নবিচ্ছিন্ন টেলিভিশনের তার—এসব দেখছিলেন, দেখছিলেন শেখ হাসিনার শোকবিহ্বল চলাচল, শরিক হচ্ছিলেন মিলাদে। বাড়িটি এখনো আগের মতোই রয়েছে।

বাড়িটির ওপরতলা শিগগিরই সাংবাদিকেরা দেখবেন। তারপর সাধারণ দর্শকের জন্য খুলে দেওয়া হবে ঘরগুলো। যাঁরা ইতিমধ্যে দেখেছেন, তাঁরা বলছেন, এ এক করুণ দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শয়নঘরে বাড়ির সদস্যদের একসঙ্গে পেয়ে সেখানেই তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। দেয়ালে এখনো রক্তের চিহ্ন রয়ে গেছে। সব ঘরবাড়ি, দেয়াল, জিনিসপত্র নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত।

৩২ নম্বর রোডের বাড়িটির নিচতলায় বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা সাময়িকভাবে হয়েছে, ওপরতলা এখনো অন্ধকারে নিমজ্জিত। শেষবারের মতো বাড়িটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই সব উত্তাল দিনে ‘ভায়েরা আমার’ ডাকের স্মৃতিচারণা করতে করতে ফিরে এলাম।

২১ জুন ১৯৮১, সচিত্র সন্ধানী

চার

সাক্ষাৎকার: ‘জিয়া যে পথে এসেছেন, সে পথে গেছেন’

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ১৭ মে ঢাকায় আসার পর তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের চেষ্টা নেওয়া হয়। কিন্তু পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এই প্রথম দেশে ফিরে এসে তিনি শোকে মুহ্যমান ছিলেন। মা–বাবা ও ভাইদেরসহ আত্মীয়স্বজনের কবর দেখতে দেখতে তাঁর মনের অবস্থা ছিল ব্যথিত, শোকবিদ্ধ। টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় আসার পরদিনই সচিত্র সন্ধানীর সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর বেদনাহত হৃদয় উন্মোচন করেছিলেন। বলেছিলেন, শোকের এই ধাক্কা সামলে উঠে তিনি সচিত্র সন্ধানীকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেবেন। গত ১১ জুন (১৯৮১ সাল) সচিত্র সন্ধানীর বিশেষ সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ যেমন অন্তরঙ্গ পরিচয়ে উদ্ভাসিত হন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতামতও প্রদান করেন।

১১ জুন বেলা ১১টায় শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যখন লালমাটিয়ায় তাঁর ফুফুর বাড়িতে উপস্থিত হলাম, তখন সদ্য স্নাতা শেখ হাসিনা সেদিনের পত্রিকা পড়ছিলেন। বাড়ির ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের তিন–চারটি বড় প্রতিকৃতি। তার পাশে শেখ মনি ও তাঁর স্ত্রীর ছবি। শোকেসে এই শহীদ পরিবারের আরও স্মৃতিচিহ্ন।

পিতৃসূত্রে পাওয়া স্বভাবসুলভ পরিচিত হাসিতে, অভ্যর্থনা জানিয়ে শেখ হাসিনা বললেন, ‘সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো মনমানসিকতা নেই। তবু আপনাকে যখন কথা দিয়েছি, সন্ধানীর পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকার দেব। সবার জন্য রইল আমার শুভেচ্ছা।’

শেখ সেলিমের বাড়িতে তাঁকে থাকতে হচ্ছে। শেখ মনির এতিম দুই ছেলে পরশ ও তাপস তাঁকে পেয়ে আর ছাড়তে চায় না। কেবলই বলছে, ‘আর তো ভালো লাগে না। কত দিন মা–বাবাকে দেখি না, ফুফু, তুমি আর যেয়ো না, আমরা তোমার কাছে থাকব।’ শেখ হাসিনার ফুফু, ওদের দাদি শেখ আসিয়া খাতুন অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘ওরে দাদু, তোদের তো তবু দাদি, চাচা, ফুফু আছে, যার কাছে কাঁদছিস, তার তো কেউ নেই রেহানা বোনটি ছাড়া।’ শেখ হাসিনা ওদের পিঠে আদর বুলিয়ে, জড়িয়ে ধরে কাঁদেন আর বলেন, ‘তোরা তো ছোট আছিস, বড় হতে হতে তবু স্মৃতি মুছে যাবে, সয়ে যাবে অনেক কিছু, কিন্তু আমাকে দেখ, এই বয়সে যে আঘাত পেলাম, যেভাবে স্বজনহারা হলাম, সে দুঃখ–জ্বালা–শোক আমি কীভাবে ভুলব? আমাকে দেখে তোরা কিছুটা সুস্থির হতে পারিস না?’ এদিকে মাকে পরশ–তাপসকে নিয়ে এবং পার্টির সভা ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখে শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুল খুব ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। এসব নিয়েই শেখ হাসিনাকে এ কদিন খুব ঝামেলায় কাটাতে হচ্ছে।

শেখ হাসিনা কথা প্রসঙ্গে ছাত্রজীবনের সেই পুরোনো দিনগুলোর গল্প করতে বললেন, ‘সাক্ষাৎকার দিতে বসলে এসব প্রশ্ন দেখে পরীক্ষার স্মৃতি জেগে ওঠে।’ তবে জীবনে যত পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন শেখ হাসিনা, তার মধ্যে স্বজনহারা ঢাকায় এসে তাঁর যে কঠিন আত্মপরীক্ষা দিতে হচ্ছে, তার তুলনা নেই। স্বামী ওয়াজেদ মিয়া অ্যাটমিক এনার্জি বিষয়ে গবেষণা করছেন দিল্লিতে। ছেলে জয় খালা রেহানার কাছে বিদেশে রয়েছে। স্বামী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ব্যস্ততা, ঝুঁকি এবং প্রাসঙ্গিক জটিলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও তাঁকে বাধা দেননি। তিনি তো জেনেশুনে বিয়ে করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রখ্যাত রাজবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়েকে, যিনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

এই সাক্ষাতের পর আবারও একদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। পত্রপত্রিকায় তাঁর বাড়ি ও সমুদয় সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়ে খবর পরিবেশনের পর শেখ হাসিনার বিবৃতিও তখন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলছিলেন, ‘যে মানসিক অবস্থার মধ্যে বাড়ি ও সম্পত্তির হিসাবপত্রে আমাকে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়, সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব তখনো আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। আমার বাবার বাড়িতে ওরা ঢুকতে দেবে না কাগজের প্রতি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর ছাড়া। এভাবে জোর করায় সেদিন সই করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, চাই না কিছু, সব নিয়ে যান। পঁচাত্তরের ভয়াল রাতে আমার মা–বাবা, ভাই, ভাবি, নয়নের মণি ছোট ভাই রাসেলকে ঘাতক নিশ্চিহ্ন করেছে, তাদের ফিরিয়ে দিন। কার কাছ থেকে সম্পত্তি বুঝে নিয়েছিলেন, আজ কী ফেরত দিতে এসেছেন, কিন্তু বাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হয়নি সেদিন, যতক্ষণ না আমি তাদের তৈরি হিসাবের কাগজে স্বাক্ষর করি। আজ বিষয়টি নিয়ে চলছে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। আমার খুব দুঃখ হয় এ ধরনের প্রচারণায়।’

শেখ হাসিনাকে সচিত্র সন্ধানীর পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। তার উত্তরে তিনি যা বলেছেন, তা নিচে দেওয়া হলো:

১. প্রশ্ন: যখন আপনার পিতার হত্যার কথা শুনলেন, সেই মুহূর্তে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?

উত্তর: আমরা তখন বেলজিয়ামে ছিলাম। শুনলাম বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। তখনো পুরো ঘটনা জানি না। শুধু বলেছিলাম, ‘ক্যু হয়েছে, তাহলে তো আমার কেউ নেই।’ জার্মানির বনে চলে এলাম। চারটা দিন যে কীভাবে কেটেছে! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মা ও রাসেল বেঁচে আছে একবার শুনলাম। পরিচিতজনেরা চার দিন পর কুলখানি করতে বলায় খুব মন খারাপ হয়েছিল, না, এ হতে পারে না। মাত্র কয়েক দিন হয় বাবাকে দেশে রেখে এসেছি, তিনি মারা যেতেই পারেন না। কিন্তু পরে জানলাম, এই মর্মান্তিক ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। তারপর থেকে এই পর্যন্ত যে কীভাবে কাটছে, তা আর কাউকে বোঝানো যাবে না।

২. প্রশ্ন: ১৯৭৫–এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কারণ কী? কেন এটা করা হয়েছিল? কোনো দেশি–বিদেশি শক্তি এর সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন কি?

উত্তর: কারণটা সুস্পষ্ট, যে সমস্ত শক্তি স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি, তারাই, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শক্তি এটা করেছে। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তা মেনে নিতে পারেনি বলেই এই আঘাত এসেছে। নির্দিষ্টভাবে দেশি–বিদেশি কোনো বিশেষ শক্তি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না, সেটা বিচারসাপেক্ষ বিষয়।

৩. প্রশ্ন: আপনি পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলছেন, ৭ জুনের আলোচনা সভাতেও বলেছেন যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারই দেশে স্থিতিশীলতা আনতে পারে। কিন্তু পঁচাত্তর সালে আপনারাই সে ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তাই বর্তমানে এই দাবি কি অসংগতিপূর্ণ নয়?

উত্তর: পঁচাত্তর সালে তদানীন্তন অবস্থা অনুযায়ী তখন রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল। বর্তমানে পরিস্থিতির বদল হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোতাবেক এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা আমরা বলছি। আমরা আমাদের এই অভিমত জনগণের কাছে তুলে ধরব, জনগণের মত অনুযায়ী আমাদের দাবি নিয়ে এগিয়ে যাব। আমরা সব সময় জনগণের মতামতকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। তাই বর্তমানে সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবি অসংগতিপূর্ণ নয়।

৪. প্রশ্ন: সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে আপনারা কী করবেন?

উত্তর: এখনো বলা যায় না। সে রকম অবস্থায় পার্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে করণীয় ঠিক করতে হবে।

৫. প্রশ্ন: ক্ষমতায় গেলে কি আবার একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করবেন?

উত্তর: জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

৬. প্রশ্ন: বর্তমান অবস্থায় দেশের সীমিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘ্নিত ও আরও জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা যখন আছে, তখন ঐক্যের প্রয়োজন আছে? বর্তমানে আপনারা ৯–দলীয় ঐক্যের মাধ্যমে, না এককভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ভাবছেন? আপনাদের কী নীতি? এ ব্যাপারে কোনো শর্ত আছে কি?

উত্তর: আমরা সব সময় ঐক্যের পক্ষে। একতাবদ্ধ হওয়া ছাড়া কিছু করা যাবে না। তবে সে ক্ষেত্রে সমঝোতার প্রশ্ন আছে। আদর্শের ঐক্য হলে তার ভিত্তি মজবুত হয়। প্রগতিশীল শক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষের যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, আমরা সেসব দলেরই ঐক্য চাই।

৭. প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ এত বিরাট একটি সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও গত পাঁচ–ছয় বছরে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি কেন? এটা কি দলীয় ব্যর্থতা, না সে অবস্থার অনুপস্থিতি?

উত্তর: পঁচাত্তরের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পর আঘাতটা মূলত এল আমাদের ওপর। সংগঠনের সব স্তরের কর্মীদের ওপর নেমে এল সব ধরনের নির্যাতন। সেই অবস্থা থেকে যে আগের মতো সংগঠিত হওয়া গেছে, সেটাই বড় কথা। আন্দোলন করেই তো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সংগঠন আবার বড় পার্টি হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ জনগণের পার্টি। জনগণের দাবিতে জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করেছে বলেই তো বড় পার্টি। কাজেই দলীয় ব্যর্থতা কোথায়?

৮. প্রশ্ন: বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যদি আপনার দলের সাহায্য চায়, তাহলে আপনারা কী করবেন?

উত্তর: বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সংবিধান অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এখন অগ্রসর হওয়া উচিত। জনগণ এখন হত্যার রাজনীতি বা কোনো সন্ত্রাস চায় না। দেশে যাতে শান্তি আসে, সরকারের সে রকম পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী এখন অবাধ গণতন্ত্র তথা সার্বভৌম পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা উচিত। জনগণ এটাই চায়।

সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাহায্য চেয়ে কোনো প্রস্তাব এখনো আসেনি। কাজেই এখনই সে বিষয়ে কীভাবে বলি? তবে তেমন যদি কোনো প্রস্তাব আসে, তবে দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলার অবস্থা বুঝে বিবেচনা নিশ্চয়ই করা হবে। পার্টির সভায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা কাজ করব।

৯. প্রশ্ন: রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যার কারণ কী?

উত্তর: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে, তদন্তেই সবকিছু বের হয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। তবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবার–পরিজনসহ হত্যা এবং পরবর্তীকালে জেলে আওয়ামী লীগের চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলেও সে হত্যার বিচার আজও হয়নি। শুধু তা–ই নয়, লন্ডনে শেখ মুজিব হত্যার তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, তাদেরও বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হয়নি। বরং হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করা হলো, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হলো। যদি সে সময় হত্যাকারীদের সাজা দেওয়া হতো, তবে আজ রাষ্ট্রপতি জিয়াকে এভাবে নিহত হতে হতো না। জিয়াউর রহমান যে পথে এসেছেন, সে পথে চলে গেলেন। হত্যার রাজনীতি চলতে থাকলে এ রকমই চলতে থাকবে।

সচিত্র সন্ধানী
১১ জুন ১৯৮১

(ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিবর্তিত)

মালেকা বেগম: লেখক–গবেষক ও অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি, ঢাকা