ভারতের উপহারের করোনার টিকা কাল আসতে পারে। টিকা রাখার জায়গা প্রস্তুত হচ্ছে, কিন্তু মানুষকে জানানোর উদ্যোগ শুরু হয়নি।
প্রথম দিকে ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকাকেন্দ্র করবে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। উপজেলা সদর, জেলা সদর ও মেট্রোপলিটন এলাকার টিকাকেন্দ্রে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে অধিদপ্তর। ভারতের দেওয়া উপহারের টিকা রাখার স্থান অধিদপ্তর ইতিমধ্যে ঠিক করেছে।
করোনা টিকা প্রয়োগ ও বিতরণ নিয়ে গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তুতি বিষয়ে জানতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, উড়োজাহাজের সময়সূচির ওপর নির্ভর করছে ভারতের টিকা কখন আসবে। বুধবার না এলে তা বৃহস্পতিবার আসবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া টিকা যত দ্রুত সম্ভব মানুষকে দেওয়া শুরু করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শুরুতে ঢাকার মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।
দুর্বল পরিকল্পনার চূড়ান্ত উদাহরণ এটি। উপজেলায় কেন্দ্র হলে খুব কম মানুষ টিকা নিতে আসবেন। এই সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুত সরে আসা উচিত।অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
গতকাল মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনা মোকাবিলায় সহযোগিতার নিদর্শন হিসেবে ভুটান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার ও সিসিলিকে ২০ জানুয়ারি থেকে টিকা পাঠাবে ভারত।
তবে ভারতের উপহারের ২০ লাখ টিকা আজ বুধবার আসছে না বলে ভারতীয় দূতাবাস সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে। সূত্র বলেছে, টিকা আসতে পারে কাল বৃহস্পতিবার।
ভারতের উপহারের বাইরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা তিন কোটি টিকা বিতরণের পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। প্রথম চালানে আসবে ৫০ লাখ। এইভাবে ছয় মাসে ছয়টি চালান আসার কথা। প্রতিবার ৫০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে অধিদপ্তর। ভারতের উপহার হিসেবে পাওয়া টিকার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কী হবে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, উপহার ও কেনা মিলিয়ে প্রথম দফায় মোট ৭০ লাখ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। সেই পরিকল্পনায় উপহারের টিকা আগেভাগে দেওয়া হবে।
১১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক মো. শামসুল হক বলেছিলেন, ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া হবে। জাতীয় কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনাতেও ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাকেন্দ্র করার কথা বলা আছে। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো টিকা দেওয়া হবে না।
তবে নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, টিকা দেওয়ার পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে—এটা নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ে কেন্দ্র সম্প্রসারণ করা হবে।
প্রথম দফায় সারা দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৩ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে, যাঁদের বয়স ৮০ বছরের বেশি। দৈনিক ২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা।
ইউনিয়ন পর্যায়ে বা গ্রামে কোনো টিকাকেন্দ্র না হলে গ্রামের মানুষকে উপজেলা সদর বা জেলা সদরে টিকা নেওয়ার জন্য আসতে হবে। বয়স্ক মানুষদের এ ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি আছে। জাতীয় কোভিড–১৯ টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় প্রথম দফায় সারা দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৩ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে, যাঁদের বয়স ৮০ বছরের বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্বল পরিকল্পনার চূড়ান্ত উদাহরণ এটি। উপজেলায় কেন্দ্র হলে খুব কম মানুষ টিকা নিতে আসবেন। এই সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুত সরে আসা উচিত।’ এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে টিকা দেওয়া সম্ভব।
গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলা হাসপাতালে দুটি দল টিকা দেবে। জেলা বা সদর হাসপাতালে চারটি দল টিকা দেবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়টি দল করোনার টিকা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকবে। এ ছাড়া বিশেষায়িত হাসপাতালে কিছু দল রাখা হবে। সারা দেশে দৈনিক ২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অধিদপ্তর।
সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মী ও অগ্রাধিকার পাওয়া মানুষদের টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু।
গতকাল পর্যন্ত কোনো তারকা বা সেলিব্রিটি কিংবা রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে টিকা কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা সরকারের নেই। সাংবাদিকেরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, কিছু দেশে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা নামীদামি মানুষকে টিকাদানের মাধ্যমে টিকা কার্যক্রম শুরু করতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ মালেক বলেন, সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মী ও অগ্রাধিকার পাওয়া মানুষদের টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হবে।এ দেশের সাধারণ মানুষই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
গতকাল মহাখালীর সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, টিকা রাখার স্থান পরিষ্কার করছেন চারজন ব্যক্তি। ওই চারজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা জানালেন, ভারত থেকে আসা টিকা সেখানে রাখা হবে।
বিকেলের দিকে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ঢাকা জেলার ইপিআইয়ের স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, কিছু কর্মী শেষ প্রস্তুতি হিসেবে কিছু সংস্কারের কাজ করছেন। এঁরা বলেছেন, কাল ভারত থেকে যে টিকা আসবে, তা এখানে রাখা হবে।
এর আগে গতকাল সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভারত থেকে আসা টিকা রাখার জন্য তিনটি বিকল্প স্থানের কথা ভাবা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে ইপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ঢাকা জেলার ইপিআইয়ের স্টোর এবং কেন্দ্রীয় ঔষধাগার।
কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সরকারকে বলেছে, করোনার টিকার গ্রহীতাদের নিবন্ধনকাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গণমাধ্যমে প্রচারণা করা দরকার। কমিটি আরও বলেছে, নিবন্ধন কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং যাঁরা নিবন্ধন করতে পারেননি, তাঁদের জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে।
গত সোমবার জাতীয় পরামর্শক কমিটির ২৫তম সভায় এসব পরামর্শের কথা উঠে এসেছে। পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্তগুলো গণমাধ্যমে জানানো হয়। তাতে বলা হয়, বড় শহরে টিকা দেওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে বলে সেখানে সিটি করপোরেশনসহ অন্য সংস্থাকে টিকাদান কাজে যুক্ত করতে হবে, টিকা দেওয়ার পর গ্রহীতাকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণ করতে হবে, টিকা কার্যকর হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারপারসন মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপহার হিসেবে টিকা পাওয়া যাচ্ছে, এটা আনন্দের খবর। তবে টিকা যেহেতু চলেই আসছে, এখন সরকারের উচিত প্রচার–প্রচারণা বাড়ানো।’