সাত দিনের প্রস্তুতিতে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছিল মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
সাত দিনের প্রস্তুতিতে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছিল মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

সম্মুখসারির যোদ্ধা

শুরুটা ছিল চ্যালেঞ্জিং

সরকার গত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার মুগদা হাসপাতালকে করোনার জন্য নির্ধারিত (ডেডিকেটেড) হাসপাতাল ঘোষণা করে। মাত্র সাত দিনের প্রস্তুতিতে পুরোপুরি কোভিড হাসপাতাল হিসেবে কাজ শুরু করে মুগদা হাসপাতাল।

কোভিড-১৯ চিকিৎসা শুরু করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। শুধু মেডিসিন বিভাগের পক্ষে পুরো হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা চালানো সম্ভব ছিল না। সব বিভাগের সাহায্য প্রয়োজন। ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য শয্যা প্রস্তুত করতে হয়, হাসপাতালকে রেড জোন, গ্রিন জোনে ভাগ করতে হয়েছে, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই), কখন কোথায় সেটি পরতে হবে, বর্জ্য থেকে যেন ভাইরাস না ছড়ায়, সে ব্যবস্থাও আমাদের করতে হয়েছে।

রুবিনা ইয়াসমিন

গত ২০ এপ্রিল থেকে মুগদা হাসপাতালে শুধু করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। করোনার মতো সংক্রামক রোগ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী—সবার মধ্যেই ভীতি ছিল। শুরুতে রোগীর সঙ্গে কোনো স্বজন থাকতে পারতেন না। রোগীকে বলতাম, আপনি সুস্থ আছেন। আশপাশের রোগীরা সুস্থ হচ্ছেন। এটি দেখে রোগী সাহস পেতেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও ভীতি ছিল। কাজ করতে করতে তাঁদের ভীতি কেটেছে।

সবার কাছেই নতুন

করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের কাছেই নতুন। বাংলাদেশের জন্যও তা–ই। শুরুতে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। কিছু অব্যবস্থাপনাও হয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্ট শুরুতে তত ছিল না। শুরুর দিকে রোগী নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘোরার খবর আসত। এখন আমাদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। দক্ষতা বেড়েছে। ব্যবস্থাপনাও ভালো। লজিস্টিক্যালি অনেকটাই ইকুইপড।

করোনায় মারা যাওয়া প্রথম রোগী

দেশে করোনায় মারা যাওয়া প্রথম রোগীর মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে আমাদের মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই পর্যালোচনার কারণে মুগদা হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুহার কমানো গেছে। মৃত্যু তথ্য পর্যালোচনা করার ফলে মৃত্যু কমাতে কী করতে হবে, সেটি বোঝা গেছে সহজে। কোন বয়সের রোগীরা মারা যাচ্ছেন, সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। একসময় মুগদা হাসপাতালে মৃত্যুহার ছিল ১৩ শতাংশ। বর্তমানে সেটি কমে ১০ শতাংশের মতো হয়েছে।

আমাদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন

সেবা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল চাঙা রাখতে প্রতিবার ডিউটি শুরুর আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মনোবিদদের একটি দল স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। হাসপাতালের করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্য রোগীদের মতো একই চিকিৎসা পাচ্ছেন।

করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের দীর্ঘদিন বাড়ি থেকে বাইরে থাকতে হয়। ডিউটি শেষে কোয়ারেন্টিন মেনে চলতে হয়। করোনাযুদ্ধে স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবারের সদস্যরাও ফ্রন্টলাইনের (সম্মুখসারি) অংশ।

ডিউটি শেষে কোয়ারেন্টিন করায় সংক্রমণের ভয় থাকে না। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ইমোশনাল ট্রমার মধ্যে থাকতে হয়। করোনাযুদ্ধে স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবারের সদস্যদের অবদান অনেক।

রোগীর চাপ কমে এসেছে

মুগদা হাসপাতালে করোনার জন্য নির্ধারিত ৩৫০টি শয্যা। আগে প্রতিটি শয্যাতেই রোগী থাকত। সাম্প্রতিক সময়ে রোগীর চাপ কমে এসেছে। করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। বর্তমানে গড়ে ১১০ জন রোগী ভর্তি থাকছেন। হাসপাতালের একটি তলায় (ফ্লোর) করোনা চিকিৎসা বন্ধ করা হয়েছে। লোকজন করোনাভীতি কাটিয়ে উঠছে।

মুগদা হাসপাতালের বহির্বিভাগে আগে দেড় হাজারের বেশি রোগী সেবা নিতেন। অন্তর্বিভাগে ভর্তি থাকতেন আট শতাধিক। হাসপাতাল শুধু করোনার জন্য নির্ধারিত করায় নন-কোভিড রোগীরা আর সেবা নিতে পারছেন না। মুগদা হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড চিকিৎসা একসঙ্গে শুরু করা দরকার। নন-কোভিড রোগীদের সেবা পেতে সুবিধা হবে। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা নয়, স্বাস্থ্যশিক্ষাও দেওয়া হয়। বিভিন্ন বিষয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সের শিক্ষার্থী রয়েছেন, যাঁদের এখন শুধু করোনা রোগী দেখতে হচ্ছে। অন্য রোগী না থাকায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।


ডা. রুবিনা ইয়াসমিন, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক