বন্ধু আনোয়ার উল আলম, আমাদের শহীদ ভাই চলে গেলেন গত ১০ ডিসেম্বর। তাঁর এই চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য অনেক বেদনার। প্রথমা থেকে প্রকাশিতব্য তাঁর নতুন বই সংকটকালে সেনাবাহিনীতে নিয়ে করোনাকালেও দুবার আমাদের কথা হয়েছিল।
১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে এমএ করেছিলেন আনোয়ার উল আলম। সে বছরই এসএম হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। তারপর বর্ণাঢ্য জীবন শুরু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। নিজ জেলা টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনী সংগঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।
স্বাধীনতার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নূরুজ্জামানকে পরিচালক করে দুই মুক্তিযোদ্ধা—টাঙ্গাইলের আনোয়ার উল আলম ও মাদারীপুরের সরোয়ার মোল্লাকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যুক্ত করেন। রক্ষীবাহিনী গঠনে এই তিনজনের ভূমিকাই ছিল প্রধান।
জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করা। এই বাহিনীর স্থায়িত্ব ছিল তিন বছর সাত মাস। বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে সে সময় এবং পরেও অনেক তর্কবিতর্ক–আলোচনা ছিল।
সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবার হত্যার পর থেকে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং ৩ ও ৭ নভেম্বরের পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমাদের যেমন জানার আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল, এখনো তেমনই আছে। ওই কয়েক মাসের ঘটনা বাংলাদেশকে আমূল পাল্টে দেয়।
এসব ঘটনার বিস্তারিত জানাবোঝা এবং সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার আগ্রহ থেকেই শহীদ ভাইয়ের মতো মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতাম। দৈনিক ভোরের কাগজ ও প্রথম আলো পত্রিকায় তাঁদের লেখা প্রকাশ করতাম। সাক্ষাৎকার ছাপতাম নিয়মিত। পরবর্তীকালে প্রথমা প্রকাশন থেকেও তাঁদের এ–বিষয়ক নানান বই প্রকাশ করেছি।
স্বাধীনতার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নূরুজ্জামানকে পরিচালক করে দুই মুক্তিযোদ্ধা—টাঙ্গাইলের আনোয়ার উল আলম ও মাদারীপুরের সরোয়ার মোল্লাকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যুক্ত করেন। রক্ষীবাহিনী গঠনে এই তিনজনের ভূমিকাই ছিল প্রধান।
আমরা জানতাম যে আনোয়ার উল আলম, সরোয়ার মোল্লাসহ রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়েছিল। এই দুজনকেই ’৭৮ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল থেকে কর্নেল পদে উন্নীত করে তাঁর কার্যভার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত করা হয়। তারপর আনোয়ার উল আলম ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, হংকংয়ে বিভিন্ন কূটনৈতিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ’৯৪–৯৫ সালের দিকে আনোয়ার উল আলম যখন ঢাকায় এসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত হন, তখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারপর তিনি ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান কানাডা। পরবর্তীকালে বাহরাইন ও স্পেনের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে অবসরে যান। অবসরের পর আনোয়ার উল আলম স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে এলে পুনরায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি। দেখা হলেই জাতীয় রক্ষীবাহিনীর গঠন, ভূমিকা ও কার্যক্রম নিয়ে লেখার জন্য উৎসাহ দিতে থাকি। মনে পড়ে, একবার ডাক্তার সাঈদা ভাবিসহ শহীদ ভাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষভাবে অনুরোধ করি। তিনি রাজি হন এবং লিখতে শুরু করেন।
বহুদিনের পড়াশোনা, খোঁজখবর ও গবেষণার মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। এ সময় বহুদিন প্রথম আলোর লাইব্রেরিতে বসে তিনি কাজ করেছেন। অনেক সময় কাটিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। তথ্য যাচাইপ্রক্রিয়া, সম্পাদনা ও প্রুফ দেখা শেষে বেশ পরিশ্রমের পর ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা। পরে আরেকটি সংস্করণ হয় বইটির। সম্প্রতি সেটির দশম মুদ্রণ প্রকাশ পেয়েছে।
সে সময় রক্ষীবাহিনী গঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের ভূমিকা—এসব নিয়ে শহীদ ভাই সাহস করে অনেক সত্য বলেছেন। যেমন আমরা জানতে পারি, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ি লতিফ সিদ্দিকীর দখল থেকে মুক্ত করেছিলেন কীভাবে; সিরাজ সিকদারকে হত্যায় রক্ষীবাহিনী যুক্ত ছিল না ইত্যাদি। এ ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের স্বার্থে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। এ জন্য নানা শাস্তি, গ্রেপ্তার, জেলও হয় অনেকের। আগস্ট থেকে নভেম্বরের ঘটনাবলি এবং তার পরের তখনকার সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি ও অবস্থান নিয়ে অনেক কিছুই তিনি বলেছেন।
সে সময় রক্ষীবাহিনী গঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের ভূমিকা—এসব নিয়ে শহীদ ভাই সাহস করে অনেক সত্য বলেছেন। যেমন আমরা জানতে পারি, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ি লতিফ সিদ্দিকীর দখল থেকে মুক্ত করেছিলেন কীভাবে; সিরাজ সিকদারকে হত্যায় রক্ষীবাহিনী যুক্ত ছিল না ইত্যাদি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর সামরিক শাসন জারি করা হলে এর বিরুদ্ধে দুই উপপরিচালক আনোয়ার উল আলম ও সরোয়ার মোল্লা নানা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাঁরা কিছু করতে পারেননি। রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নূরুজ্জামান তখন দেশের বাইরে। এরপর কিছু সময় অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর পুরো রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী কেন ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখেনি? শহীদ ভাই লিখেছেন, সেদিন সকালে তাঁরা উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপর বাসায় গিয়ে তাঁদের পাওয়া যায়নি। পঁচাত্তরের আগে ও পরের ঘটনার অনেক কিছু জানতে পারি তাঁর বই থেকে।
১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাক, জেনারেল ওসমানী, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুরের মধ্যে বেশ বিতর্ক হয় রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে। খন্দকার মোশতাক, জেনারেল ওসমানীরা চেয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের আনসার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে ভাগ করে দিতে। কিন্তু জিয়াউর রহমান ও এম এ মঞ্জুরের প্রচেষ্টায় তাঁদের সবাইকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়। জিয়া ও মঞ্জুর ভেবেছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক বাহিনী পেলে সেনাবাহিনী আরও সংগঠিত হবে।
’৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিলেন। তবু তাঁদের নিয়ে একটা সন্দেহ ও দুশ্চিন্তা সব সময়ই ছিল। এই ভয় থেকেই রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে তাঁদের বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী কেন ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখেনি? শহীদ ভাই লিখেছেন, সেদিন সকালে তাঁরা উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপর বাসায় গিয়ে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
রক্ষীবাহিনীর সত্য–মিথ্যার সফলতার পর আনোয়ার উল আলমকে আমরা আরও উৎসাহিত করি নতুন বই লিখতে। ২০১৮ সালে লিখতে শুরু করেন সংকটকালে সেনাবাহিনীতে। ১৫ আগস্টের পর রক্ষীবাহিনীর সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ, আনোয়ার উল আলম–সরোয়ার মোল্লাকে স্বীকৃতি–সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে জিয়া–মঞ্জুর সহযোগিতা করেছেন। নানা সন্দেহ–অবিশ্বাস ও সংকটকালেও তাঁরা সেনাবাহিনীতে টিকে ছিলেন। সে সময়ের সামরিক ও রাজনীতির নানা বিষয়ে বেশ কিছু নতুন তথ্য প্রকাশিতব্য বইটিতে রয়েছে।
সংকটকালে সেনাবাহিনীতে বের করার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বেশ সময় ধরে আনোয়ার উল আলম বইটি প্রায় চূড়ান্ত করেছিলেন। চূড়ান্ত করতে তাঁর সঙ্গে আর বসতে পারিনি আমরা। ইচ্ছা থাকার পরও কোভিডের কারণে আর হয়নি। শিগগিরই আমরা বইটি প্রকাশ করব।
আজ ১ জানুয়ারি আনোয়ার উল আলমের জন্মদিন। আমরা তাঁকে স্মরণ করছি একজন হৃদয়বান মানুষ হিসেবে। একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভবিষ্যতেও মনে রাখব।