বাংলাদেশে তো আগে থেকেই একটি বড় সংখ্যার মানুষ দরিদ্র ছিল। করোনার অর্থনৈতিক অভিঘাতে এর সঙ্গে আরও মানুষ যোগ হয়েছে। এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পুরোনোর সঙ্গে নতুন দারিদ্র্যও দূর করা। কারণ, আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে দারিদ্র্য দূর করার একটি লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমার প্রথমত মনে হয়েছে, শুধু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) দিয়ে এই নতুন দারিদ্র্য দূর হবে না। এর জন্য আমাদের আরও কিছু উদ্যোগ লাগবে।
আমাদের জিডিপি নিয়ে আগে থেকে একটি সমালোচনা কিন্তু আছে। সেটা হচ্ছে জিডিপি যত দ্রুত বাড়ে, দারিদ্র্য তত কমে না। দেশের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রেও জিডিপির ভূমিকা কম। ফলে আমাদের একই সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য কমানোর অ্যাজেন্ডাকে রাখতে হবে। কারণ, করোনার জন্য অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, এর ফলে দেশে বৈষম্য আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে থাকলে এখান থেকে আর ফিরে আসা না-ও যেতে পারে। যে কারণে শুধু কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্রদের সহায়তা দিলেই হবে না। এ জন্য একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রয়োজন।
তবে এটা বলা যতটা সহজ, করা ততটা কঠিন। কারণ, বিশ্বের অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র অর্থনৈতিক তৎপরতা পুনরুদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে। অর্থনৈতিক তৎপরতা যত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হবে, তত দ্রুত নতুন দরিদ্ররা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। এখানে আশার কথা হলো, বাংলাদেশে অর্থনীতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় দ্রুত পুনরুদ্ধার হচ্ছে। সরকার তার নিজের সক্ষমতা ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখে পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমরা লকডাউনের প্রভাব নিয়ে জরিপ করেছিলাম। সেখানে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের সঞ্চয়ের সক্ষমতা দেখে মনে হয়েছিল, আমাদের মতো দেশ এই পরিস্থিতি বেশি দিন সামলাতে পারবে না।
এই মানুষগুলো মূলত দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে বসবাস করত। ফলে করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে এলে ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হলে তারা দ্রুত দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এসব মানুষের জন্য সরকার থেকে নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর কোনটি কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। কারণ, আমাদের তো চিন্তা করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা যেসব খাদ্যসামগ্রী গরিব মানুষের জন্য দিচ্ছি, তা তাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে কি না। যে তালিকার ভিত্তিতে তা দেওয়া হচ্ছে, তা ঠিক আছে কি না। নতুন দরিদ্ররা ওই তালিকায় আছে কি না। এসব প্রশ্নের মীমাংসা ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অনেক বেশি বরাদ্দ দিয়েও কোনো লাভ হবে না।
করোনার জন্য অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, এর ফলে দেশে বৈষম্য আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে থাকলে এখান থেকে আর ফিরে আসা না-ও যেতে পারে।
আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সরকার দ্রুত নিয়মিত অর্থনৈতিক তৎপরতা চালু করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ও ক্ষেত্রে যে লকডাউন চলছিল, তা দ্রুত শিথিল করে এনেছে। তা মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার চালু করতে সহায়ক হয়েছে। আমাদের দেশে নতুন দরিদ্রদের একটি বড় অংশ অর্থনীতির অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আবার আমাদের এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাত কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। যেমন তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে ঝুট ব্যবসাসহ অন্য অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে। ফলে যখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলো চালু থাকবে, তখন ওই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলো সচল থাকবে। এখন প্রধান কাজ হবে এসব প্রাতিষ্ঠানিক খাতকে যত দ্রুত চালু করা যায়।
তবে এটা ঠিক, আমরা শুরুতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এতে আমাদের এখানে অনেক বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। ঢাকার অর্ধেক মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, আবার কাজে ফিরেছে। আশপাশের অনেকে সংক্রমিত হওয়ার পরও মানুষ তার নিজের কাজ বন্ধ করেনি। এটা আমাদের একধরনের শক্তি দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির যে সরবরাহব্যবস্থা, নিয়মিত অর্থনৈতিক তৎপরতা চালু রাখতে এই মনোভাব আমাদের অনেক কাজে দিয়েছে। এটাই আমাদের নতুন ও পুরোনো দারিদ্র্য বিমোচনে একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজে দেবে।
সরকার তার সক্ষমতা অনুযায়ী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে আমাদের জিডিপি অনেক বেশি কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা হয়নি। আমাদের অনেক প্রতিবেশী দেশ এ ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে। বিশ্ব অর্থনীতির যেসব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ যুক্ত আছে, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আমি মনে করি, বাজারের এই নিয়মেই নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে সুরক্ষা দেওয়া যাবে।
তবে এ ব্যাপারে আমরা এখনো শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। কারণ, আমাদের অর্থনীতির দুটি বড় শক্তি বিশ্ববাজারনির্ভর। তৈরি পোশাক খাত ও প্রবাসী আয়—এ দুটি খাতই করোনার কারণে শুরু হওয়া বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেগুলো এখনো ঠিক হয়নি। আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে বলে শুনছি, সেটি আগের চেয়ে বেশি মারাত্মক হয় কি না, সেটাও দেখতে হবে।
আমরা আশা করি, আগামী বছরের মধ্যে আমাদের জিডিপি করোনাপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাবে। তাতে হয়তো আমাদের নতুন দারিদ্র্য কমে আসবে। কিন্তু এখানে দেখার বিষয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন হয় কি না। যেসব পণ্য ও সেবার উৎপাদনের সঙ্গে আমরা জড়িত, সেগুলোর চাহিদার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসে কি না, তা আমাদের দেখতে হবে। এ ধরনের পরিবর্তন হলে তার সঙ্গে আমাদের খাপ খাওয়াতে হবে। সেটা যত ভালোমতো করতে পারব, আমাদের দারিদ্র্য ও অর্থনীতির ঝুঁকি তত কমে আসবে।
আবার এই করোনার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য–সংঘাত শুরু হয়েছে, তার মধ্যেও বাংলাদেশকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। এই সংঘাত থেকে আমাদের এখানে বেশ কিছু সুযোগও তৈরি হতে পারে। সেগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
করোনা সংকট শিগগিরই কাটবে না বলেও একটি মত আছে। ভ্যাকসিন আসছে, সেটি ভালোমতো কাজ করবে বলেও আমরা আশা করি। তবে এ ধরনের রোগ বা এর চেয়েও বড় সমস্যা সামনে আরও আসবে কি না, তা–ও আমরা বলতে পারি না। তবে এটা অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে সামনের পৃথিবীতে স্বাস্থ্যভিত্তিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক তৎপরতা বাড়বে। সেটার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন ও সেবা—দুই দিকেই আমাদের জন্য সুযোগ আছে।
● কে এ এস মুর্শিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক