শুট, শুট বলেই লিয়াকতের গুলি

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান

কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে টেকনাফের দিকে গেলে মনে হবে কোনো যুদ্ধ এলাকা। পথে পথে যানবাহন থামিয়ে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর তল্লাশি। কোনো কোনো তল্লাশিচৌকিতে নাম-পরিচয়ের পাশাপাশি ফোন নম্বরও দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কারও সঙ্গে যদি ছবিসংবলিত পরিচয়পত্র না থাকে, তাহলে তার অবস্থা কী হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ রকম ‘বিপৎসংকুল’ পথ ধরে কক্সবাজার শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে প্যাঁচার দ্বীপের নীলিমা রিসোর্ট থেকে আমাদের যাত্রা টেকনাফের পথে মারিশবুনিয়ার দিকে। নীলিমা রিসোর্ট থেকে মারিশবুনিয়ার দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। এক ঘণ্টার এই পথ পেরোতে দেখা মেলে একক ও যৌথ বাহিনী মিলে নয়টি তল্লাশিচৌকির।

৩১ জুলাই বিকেলে সেই পথ ধরে, এতগুলো তল্লাশিচৌকি পেরিয়ে শখের টানে মারিশবুনিয়ায় গিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। কিন্তু এতগুলো তল্লাশিচৌকি তাঁকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। নীলিমা রিসোর্টেও তিনি আর ফিরতে পারেননি, পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা বুক নিয়ে যেতে হয়েছে হাসপাতালের মর্গে।

রিসোর্ট থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বেলা তিনটার দিকে সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে নিজের রুপালি রঙের এলিয়ন গাড়িটির চালকের আসনে বসে পথে নেমেছিলেন সিনহা। আমরাও চলেছি সেই পথে, সেই সময় ধরে। আর বোঝার চেষ্টা করছি, সেদিন সিনহার যাত্রা ও তার পরের অবস্থা কেমন ছিল। সমুদ্র ও পাহাড়কে আলাদা করা মেরিন ড্রাইভ ধরে আমরা চলেছি মধ্যম গতিতে, ভাড়া করা গাড়িতে। মসৃণ পথে গাড়ি চলুক, এই ফাঁকে ফিরে আসি নীলিমা রিসোর্টে, যেখানে এই দলের আরও দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূর ছিলেন।

ঢাকার শাহীন স্কুল এবং উত্তরার রাজউক কলেজ থেকে পাস করা সিনহা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আইবিএ–তে পড়ার জন্য। সেটা শেষ না করেই ৫১তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। ২০০৪ সালে কমিশন লাভ করেন। এরপর ১৬ বছর চাকরি করে ২০১৮ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।

এ তথ্য জানিয়ে সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেন, ‘সিনহা আমাকে একাধিকবার বলেছিল, আম্মু, সেনাবাহিনীতে চাকরি করে যে নলেজ গেইন করার দরকার, সেই নলেজ আমার হয়েছে। আমি নতুন কিছু করব।’ সৃজনশীল কাজ করার জন্য মূলত তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।

নীলিমা রিসোর্ট। এখানে একটি কটেজ ভাড়া নিয়েছিলেন সিনহা ও তাঁর দল। ছবি: প্রথম আলো

পুলিশের কাছ থেকে জানা গেল, এক বছর আগে সিলেটের একটি স্থানে বেড়ানোর সময় সিনহার সঙ্গে পরিচয় হয় শিপ্রা দেবনাথের। এরপর তাঁরা বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতেন। শিপ্রা দেবনাথ পুলিশকে জানান, মানসিকভাবে তাঁরা পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন।

শিপ্রা দেবনাথ ১২ আগস্ট ইউটিউবে একটি ভিডিও আপলোড করেন। সেখানে বলেন, গত মার্চ মাসে নওগাঁর আলতাদিঘিতে বেড়াতে গিয়ে তাঁরা ভিডিও করার পরিকল্পনা করেন। তিনি পরিচালক আর সিনহা প্রযোজক। কক্সবাজারে তাঁরা বেজ ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নেন পাহাড় আর সাগরের কারণে।

এই দলের আরেক সদস্য সাহেদুল ইসলাম সিফাত পুলিশকে বলেন, গত বছর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে সিনহার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তিনি ক্যামেরাম্যান হিসেবে দলে যুক্ত হন। এই দলের চতুর্থ সদস্য তাহসিন রিফাত নূর প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে যাওয়ার ১০-১৫ দিন আগে সিনহার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। শিপ্রা ও সিফাতের সঙ্গে চেনাজানা থাকায় তিনি সম্পাদনার কাজ পান। দলের তিনজনই স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী। তবে কাজের জন্য সিফাতকে মাসে ২৫ হাজার এবং নুরকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। সঙ্গে থাকা ও খাওয়ার খরচ। সব খরচই বহন করতেন সিনহা।

প্রজেক্ট কক্সবাজার
সিফাত প্রথম আলোকে জানান, ভিডিও ধারণের কাজে ৩ জুলাই তাঁরা কক্সবাজারে আসেন। প্রথমে ওঠেন কলাতলীর একটি হোটেলে। সেখানে ৭-৮ দিন থাকার পর নীলিমা রিসোর্টে যান।

নীলিমা রিসোর্টের কর্মচারী লোকমান আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, মাসে ৭০ হাজার টাকায় নীলিমা রিসোর্টের চড়ুই নামে দুই রুমের একটি কটেজ তাঁরা ভাড়া নেন। এটি অনেকটা সাইক্লোন শেল্টারের মতো দেখতে।

তাহসিন রিফাত নূর জানালেন, এক মাস ধরে রিসোর্টে থাকলেও তিনি রিসোর্টের বাইরে তেমন যেতেন না। রিসোর্টে বসে আগের দিনের শুটিংয়ের ভিডিও সম্পাদনা করতেন। শিপ্রাই ছিলেন এই দলের পরিচালক। তিনি ভিডিওতে উপস্থাপনাও করতেন। ইউটিউবে প্রচারের জন্য ভিডিও ধারণ করা হতো।

মারিশবুনিয়ার পথে সিনহা
দলের সদস্য তাহসিন বলেন, ৩০ জুলাই রাতে পরিকল্পনা হয় মারিশবুনিয়ার মুইন্যার পাহাড়ে ‘টাইমল্যাপস’ দৃশ্যধারণ করা হবে। প্রতিটি ভিডিওতে একটা টাইমল্যাপস ভিডিও রাখা হবে। অনেকগুলো ছবিকে একত্র করে এক মিনিটের ভিডিও বানানোই হচ্ছে টাইমল্যাপস দৃশ্য। সেটা ছিল পাহাড়ের ওপর থেকে আকাশের মেঘ দেখা। অনেকক্ষণ ধরে (এক ঘণ্টা) অনেক ছবি ধারণের পর সেটা এক মিনিটে সম্পাদনা করলে দেখা যাবে মেঘগুলো দ্রুত দৌড়াচ্ছে। এমন দৃশ্য ধারণ করার জন্য ৩১ জুলাই দুপুরের দিকে ক্যামেরা নিয়ে সিনহা ও সিফাত পাহাড়ে যান।

আমাদের ঘড়িতে এখন বিকেল সোয়া চারটা। নয়টি তল্লাশিচৌকির ধকল কাটিয়ে সোয়া ঘণ্টায় আমরা চলে এলাম মারিশবুনিয়াতে। পেছনে ফেলে এসেছি শামলাপুর তল্লাশিচৌকি, যেখানে পুলিশের গুলিতে সিনহা নিহত হয়েছিলেন। সেটা দেখব ফেরার পথে, আপাতত আমাদের গন্তব্য মারিশবুনিয়া পাহাড়।

পথের মাইলফলকে লেখা টেকনাফ ১৮ কিলোমিটার। এখান থেকে আরও ১৮ কিলোমিটার গেলে তবেই টেকনাফ। এই মাইলফলক ছাড়িয়ে ২০০-৩০০ মিটার সামনে গেলেই বাঁ হাতে নিচু ধানখেতের পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা সড়ক নেমে গেছে পাহাড়ের দিকে। ডানে বিশাল সমুদ্র। পথের ধারে গাড়ি রেখে ১০ মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম বড়ডেইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই স্কুলের পাশেই সেই পাহাড়, যেখানে সিনহা গিয়েছিলেন।

কক্সবাজার থেকে এই পথে আসতে এ রকম আরও অনেক পাহাড় চোখে পড়ে। কিন্তু এত পাহাড় বাদ দিয়ে কেন এই পাহাড় সিনহা বেছে নিয়েছিলেন, তার কোনো জবাব মেলেনি। তবে সিফাত পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, এই পাহাড় অনেক উঁচু, সে কারণে তাঁরা এটাকে পছন্দ করেছিলেন। ৩১ জুলাই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সিনহা ও সিফাতকে এই পাহাড়ের কাছে দেখেছিলেন মারিশবুনিয়ার মানুষ।

মারিশবুনিয়ায় নেমে দেখা হলো বাহারছড়া ইউনিয়নের সদস্য ফরিদ উল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানালেন, এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। সিনহা নিহত হওয়ার পরদিন থেকে তাঁরা গ্রাম ছেড়েছেন। পাছে বিপদ হয়, সেই ভয়ে এখন কেউ কিছু বলতেও চান না।

পাহাড়ে আলো, ডাকাতের গুজব
মাথাভাঙ্গা গ্রামের জসিম উদ্দিনের ৯ বছরের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র শহিদুল ইসলাম জানাল, সেদিন সিনহা ও সিফাতকে পাহাড়ে পথ দেখিয়ে মাদ্রাসায় চলে আসে সে। এরপর আর কিছুই জানে না সে। স্থানীয় এক দোকানি জানালেন, এই পাহাড়ে কোনো গাছপালা নেই। এখানে সরকারিভাবে বনায়ন করা হচ্ছে। সিনহা ও তাঁর সঙ্গী এশার নামাজের আগ পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন। দূর থেকে ছোট ছোট আলো দেখা যাচ্ছিল। এতে গ্রামের অনেকে সন্দেহ করছিল, সেখানে ডাকাত আছে। পাহাড়টি হাকিম ডাকাতের এলাকা বলে পরিচিত।

স্থানীয় আরেক দোকানি জানান, রাত আটটার দিকে মসজিদের সামনে আসেন স্থানীয় বাহারছড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. আইয়াজ, কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য নুরুল আমিন ও স্থানীয় যুবক নিজাম উদ্দিন। তাঁরা বলতে থাকেন, পাহাড়ে ডাকাত এসেছে। হাফেজ জহির আহমদ বলেন, ওরা ডাকাত না সেনাবাহিনীর লোক। কিন্তু ওই যুবকেরা তা শুনছিলেন না।

এই সেই পাহাড়, যেখানে ভিডিও ধারণ করতে গিয়েছিলেন সিনহা ও সিফাত। ছবি: প্রথম আলো

নিজাম উদ্দিন মসজিদের মাইকে বলতে থাকেন, ‘তোমরা যদি ডাকাত না হয়ে থাকো, তাহলে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে প্রমাণ দাও। নইলে পুলিশকে খবর দেওয়া হবে।’ এর কিছুক্ষণ পর সিনহা ও সিফাত পাহাড় থেকে নেমে আসেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাঁরা পাহাড় থেকে নেমে আসার পর একজন সিনহার মুখে টর্চের আলো ফেলেন। এতে সিনহা ক্ষুব্ধ হন। সিফাত পুলিশকে বলেন, পাহাড় থেকে মাইকের কোনো আওয়াজ তাঁরা শোনেননি। আর চোখে টর্চের আলো ফেলার পর সিনহা ধমক দিয়ে বলেন, ‘এই লাইট চোখে মারছ কেন, নামাও।’ এরপর ১০ মিনিট হেঁটে তাঁরা গাড়িতে ওঠেন।

ডাকাত সন্দেহে পুলিশকে ফোন
পাহাড় থেমে নেমে গ্রামের পথ ধরে সিনহা ও সিফাত যখন গাড়িতে উঠছিলেন, তখন সেখান থেকে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে ফোন করেন মারিশবুনিয়ার বাসিন্দা নুরুল আমিন। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ওই দিন নুরুল আমিন আটবার লিয়াকতকে ফোন করেন। প্রতিবারই এদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন। নুরুল আমিন ফোনে লিয়াকতকে জানান, এরা সিলভার কালারের গাড়িতে উঠে কক্সবাজারের দিকে চলে যাচ্ছে। নুরুল আমিনের ফোন পেলে শামলাপুর ১৬ এপিবিএনের ইনচার্জ শাহজাহানকে ফোন করেন লিয়াকত আলী। তিনি সিলভার কালারের গাড়ি ও এর চালককে আটকাতে বলেন। বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রটি মূল সড়ক থেকে ৭০০-৮০০ মিটার দূরত্বে। লিয়াকত নন্দদুলাল রক্ষিত নামের এক এসআইয়ের মোটরসাইকেলে করে মেরিন ড্রাইভের মূল সড়কের সামনে এসে অবস্থান নেন।

গুলিবিদ্ধ হলেন সিনহা
সিনহা ও সিফাত যেখান থেকে গাড়িতে ওঠেন, সেখান থেকে শামলাপুর তল্লাশিচৌকির দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। এই তল্লাশিচৌকির দুই পাশে বড় একটি বাজার। এক পাশে সাগর থেকে ধরে আনা মাছের পাইকারি বাজার, অন্যদিকে সাধারণ বাজার। একটি মসজিদও আছে সেখানে। বাজারের দোকান থেকে শামলাপুর তল্লাশিচৌকির দূরত্ব ১০০ গজের বেশি নয়। এ রকম একটি জনাকীর্ণ স্থানে এসে রাত নয়টার দিকে পৌঁছান সিনহা ও সিফাত।

এই স্থানে গাড়ি রেখেই পাহাড়ে যান সিনহা ও সিফাত। ছবি: প্রথম আলো

ঘটনার পর সিফাত পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বলেন, ‘পাহাড় থেকে নেমে আসার পর প্রথমে বিজিবির একটা তল্লাশিচৌকি তাঁদের থামায়। সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দিলে তাঁরা যেতে বলেন। এর ১০-১২ মিনিট পর তাঁরা আসেন শামলাপুরের এপিবিএন পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে। তখন রাত ৯টা ১৭ থেকে ২০ মিনিট হবে। সেখানে পৌঁছানোর পর বিডিআরের মতো পোশাক পরা একজন (এপিবিএন সদস্য) গাড়ি থামাতে বলেন। সিনহা গাড়ির দরজা খুলে নিজের পরিচয় দিলে তিনি চলে যেতে বলেন। তখন গাড়ি চলছিল। এরপর সিনহা চলে যেতে উদ্যত হলে তিনি আবার বলেন, দাঁড়ান। এরপর একজন (লিয়াকত) এসে সিনহার পরিচয় জানতে চান। সিনহা নিজের পরিচয় দিলে তিনি (লিয়াকত) রাস্তার ওপর গাড়ির সামনে একটি ড্রাম ফেলে দেন। সামনে এ সময় আরও ৪-৫ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তখন সিনহাও দরজা খুলে নামেন। যিনি সিনহার দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন, তাঁকে সিনহা বললেন, কাম ডাউন, কাম ডাউন। এরপর গুলির শব্দ শুনি, গাড়ির সামনে এসে দেখি তিনি মাটিতে পড়ে আছেন। আমি নামার সময় গাড়িতে অস্ত্র দেখেছিলাম। কিন্তু তিনি (সিনহা) নামার সময় অস্ত্র হাতে নিয়ে নেমেছেন কি না, তা খেয়াল করিনি।’ সিফাত বলেন, শুরুতে তাঁদের পেছনে দুটি গাড়ি ছিল, এরপর খুব অল্প সময়ে সেখানে লোক জমে যায়।

ঘটনার সময় উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্র বের করেছে, শুট শুট’ বলে লিয়াকত গুলি ছোড়েন।

সিনহার পেটে লাথি মারলেন একজন
প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল আবছার পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানান, গুলির ঘটনার কিছুক্ষণ পরে সেখানে আসেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। সিনহা তখন পানির জন্য কাতরাচ্ছিলেন। ওসি এসে ভুয়া মেজর ভুয়া মেজর বলে কথা বলেন। এ সময় ওসির সঙ্গে আসা রুবেল নামের এক পুলিশ সদস্য গালি দিয়ে বলেন, ‘শালার পুত কিসের পানি?’ এরপর তিনি সিনহার পেটে লাথি মারেন। তখনো সিনহা নড়াচড়া করছিলেন। ঈদের আগের রাতের কারণে তখন রাস্তায় গাড়ি ছিল খুব কম। একটি মিনিট্রাক এলে সেটা থামায় পুলিশ।

ট্রাকে তোলা হলো সিনহাকে
টেকনাফে গরুর চালান নামিয়ে দিয়ে কক্সবাজারে ফিরছিলেন মিনিট্রাকচালক সাইফুল আফসার। তিনি জানান, শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যরা তাঁকে থামান। বলেন, তোকে একটি আহত লোককে নিতে হবে। এ সময় শামলাপুর তদন্তকেন্দ্রের ক্যাশিয়ার তাঁর গাড়ির চাবি কেড়ে নেন। তিনি কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাইফুল জানান, তিনি আসার পর আরও ৬-৭ মিনিট সিনহা বেঁচে ছিলেন। এরপর চারজন ধরে সিনহাকে ট্রাকে তুলে দেন।

সাইফুল বলেন, রাত পৌনে ১০টার দিকে সিনহাকে ট্রাকে তোলার পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠকর্মী ট্রাকের ওপরে উঠে লাশের ছবি তুলতে শুরু করেন। তাঁকে ভিডিও রেকর্ড করতে দেখে পুলিশ তাঁর পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ তাঁর হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তাঁর পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। তাঁকে ধমক দিয়ে থামতে বলেন। সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে তাঁর দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।

রিসোর্টে অভিযান
সিনহা নিহত হওয়ার পর রাত ১২টার দিকে ২০ থেকে ২৫ জন পুলিশ রিসোর্টে যান। তাঁরা সেখানে গিয়েই ঘরে তল্লাশি করতে থাকেন। সেখান থেকে শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিনকে রামু থানায় ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। রিসোর্ট থেকে প্রজেক্টের যাবতীয় ভিডিও ও এডিটিংয়ের তিনটি হার্ডড্রাইভে (৪ টেরাবাইট, ২ টেরাবাইট ও ১ টেরাবাইট) যা ছিল, সব নিয়ে যায় পুলিশ।

সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশ টেকনাফ থানায় দুটি ও রামু থানায় একটি মামলা করে। একটি অস্ত্র ও পুলিশের ওপর হামলা, একটি হত্যা মামলা। রামু থানায় অপর মামলাটি হয় মাদক আইনে। পুলিশ দাবি করে, সিনহার গাড়ি ও নীলিমা রিসোর্টে তল্লাশি করে জার্মানিতে তৈরি একটি পিস্তল, ৯টি গুলি, ৫০টি ইয়াবা, ২টি বিদেশি মদের বোতল এবং ৪ পোঁটলা গাঁজা পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনেও নীলিমা রিসোর্টে অবস্থানরত দুজনের কেবিন তল্লাশি করে পুলিশের দেশি-বিদেশি মদ ও গাঁজা উদ্ধারের কথা উল্লেখ আছে।

শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্ট, যেখানে গুলিতে নিহত হন সিনহা। ছবি: প্রথম আলো

মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সিনহার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয় দুই বাহিনীর ভেতর। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাপ্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ৫ আগস্ট কক্সবাজারে এসে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

পরে সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এ ঘটনায় কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। মামলায় তিনি সিনহাকে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার অভিযোগ করেন।

পূর্বপরিকল্পিত, না তাৎক্ষণিক হত্যা
সিনহা হত্যার ঘটনায় একটি পক্ষ বলছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আর অন্য পক্ষ বলছে, এটা তাৎক্ষণিক ঘটনা। এক পক্ষের দাবি, কক্সবাজারে চাকরির সময় ইয়াবা নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সিনহা। তখন টেকনাফের ওসি ছিলেন রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া। আবার এপিবিএনের তল্লাশিচৌকিতে থানা পুলিশ কেন গেল, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এক পক্ষ বলছে, ডাকাত ধরতে গেলে বুলেটপ্রুফ পোশাক পরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা গেছেন সাধারণ পোশাকে। থানায় অভিযোগের ক্ষেত্রে জিডির বইতেও ঘষামাজা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলার ক্ষেত্রেও এক পক্ষের দাবি, ডাকাতির নাটক সাজিয়ে সিনহাকে খুন করা হয়েছে।

কক্সবাজার পুলিশ জোর দাবি করে বলছে, এটা তাৎক্ষণিক ঘটনা। আগে থেকে পরিকল্পনা করে সিনহাকে হত্যা করার কোনো কারণ নেই।

কক্সবাজারের এক আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেছেন, এখানে পুলিশের অস্ত্র থেকে গুলি করার জন্য কাউকে দোষারোপ করা হয় না। বরং ইয়াবা বন্ধের অজুহাতে এসব গুলির ঘটনায় পুরস্কৃত করা হয়। পুলিশের অস্ত্র থেকে যেকোনো গুলিবর্ষণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক তদন্তের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পুলিশ প্রবিধানের সেই বিধান মানতে তদন্তও হয়েছে। কিন্তু এসব তদন্তে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।

ওই আইনজীবী বলেন, টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশও পদক পেয়েছেন ‘ক্রসফায়ার’ করে। হয়তো সেই কারণে, সেই সাহসে লিয়াকতও গুলি ছুড়েছিলেন। হয়তো তিনিও নিশ্চিত ছিলেন, প্রদীপের মতো তাঁরও কিছু হবে না।

সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলছিলেন, ‘সবার সব ব্যথা, বেদনা হয়তো একদিন মিটে যাবে, শুধু যাবে না আমাদের। আমরা আর কোনো দিনই ফিরে পাব না প্রিয় ভাইটিকে। যে ভাই আবদার করে, খুনসুটি করে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। ভাই এখন আমাদের কাছে শুধুই চোখের পানি।’