গত অক্টোবরে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শেলডন ইয়েট। বিশ্ব শিশু দিবসকে সামনে রেখে তিনি কথা বলেছেন শিশু সাংবাদিক গার্গী তনুশ্রী পাল–এর সঙ্গে। বাংলাদেশে শিশুদের সমস্যা এবং তার সম্ভাব্য সমাধানে ইউনিসেফ, বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি।
গার্গী তনুশ্রী পাল: বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত! নতুন প্রতিনিধি হিসেবে এখন পর্যন্ত কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? সামনে কোন কাজগুলোতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবছেন?
শেলডন ইয়েট: বাংলাদেশে এসে আমি অনেক কিছু দেখছি, শিখছি। চারদিক থেকে প্রতিনিয়ত এত কিছু শিখছি যে মনে হচ্ছে যেন স্কুলে ফিরে গেছি। এখানে অনেক যোগ্য মানুষ আছেন। তাই আমার বিশ্বাস, সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এবং বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আমরা সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
গার্গী: একজন শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময় দেখেছি, অনেক শিশু স্কুলে যায় না বা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে; যার মূল কারণ হলো অর্থের জোগান দেওয়ার সামর্থ্য তাদের পরিবারের নেই। একই সঙ্গে ঢাকায় বসবাসের সুবাদে আমি দেখেছি, আমার বয়সী অনেক শিশু রাস্তায় থাকে। যেহেতু ইউনিসেফ এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে, সরকার ও ইউনিসেফ তাদের জন্য আরও কী করতে পারে?
শেলডন: সরকার, ইউনিসেফের মতো প্রতিষ্ঠান এবং অন্য সবার পক্ষ থেকে এই শিশুদের সহযোগিতা করা দরকার। যে বিষয়গুলো সব সময় খালি চোখে দেখা যায় না, সে বিষয়গুলোকেও আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। এখানে অবশ্যই দারিদ্র্য আছে, তবে এটি একমাত্র সমস্যা নয়। পথশিশুদের সমস্যাই বলে দেয় যে এখানে অন্যান্য কারণও আছে। এখানে পারিবারিক নির্যাতন একটা বড় সমস্যা, যা অনেক সময়ই পারিবারিক বন্ধন ভেঙে দেয়। ফলে অনেক শিশু অসুখী পরিবার ছেড়ে পথে চলে আসে।
পথে আসার আরেকটা কারণ হলো—শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। ঝরে পড়া শিশুরা যেন পড়াশোনায় ফিরে আসতে পারে, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এবং ঝরে পড়ার সঠিক কারণগুলোও খুঁজে বের করতে হবে। আমি মানুষকে বলতে শুনেছি, শিশুদের ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা প্রয়োজন। হ্যাঁ, এটা দরকার। তবে শাসন আর সহিংসতার মধ্যে পার্থক্য আছে। আর এটাও উদ্বেগের একটি বিষয়। কাজেই সরকারকে পথশিশুদের যাপিত জীবনের সমস্যাগুলোকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং এর বহুমুখী ফলাফলগুলো অনুধাবন করতে হবে। এ বিষয়ে সহজ কোনো সমাধান নেই। আমি এটাকে একটি সামগ্রিক সমস্যা হিসেবেই দেখছি। আরেকটি বিষয় আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়—শিশুদের জানা দরকার যে তারা সহযোগিতা পেতে পারে। ইউনিসেফ ও সমাজসেবা অধিদপ্তর যৌথভাবে একটি সরকারি হেল্পলাইন পরিচালনা করে, যার নম্বর হচ্ছে ১০৯৮। প্রতিদিন কর্মীদের মাধ্যমে শিশুরা সাহায্য পেতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
গার্গী: আমাদের দেশে মেয়েরা এখনো নানা ঝুঁকির মধ্যে আছে এবং এখনো শিশুবিবাহের হার অনেক বেশি। ইউনিসেফ এ প্রেক্ষাপটে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে কী করছে?
শেলডন: এখানে ৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু আছে, যাদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। এটি একটি বিস্ময়কর সংখ্যা। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই শিশুবিবাহ বন্ধে বদ্ধপরিকর। ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুবিবাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হবে, এ শর্তে বাংলাদেশ এসডিজিতে স্বাক্ষর করেছে এবং এটি এ দেশের টেকসই উন্নয়নের একটি অন্যতম লক্ষ্য। এটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু এখানে শিশুবিবাহের হার হ্রাসের গতি খুবই শ্লথ। মনে রাখতে হবে—শিশুবিবাহ একটি অপরাধ। কাউকেই ছোটবেলায় বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এর ক্ষতিকর দিকটিও আমাদের নজরে রাখতে হবে। শিশুবিবাহ কেবল শিশুর স্বাস্থ্যের ওপরেই প্রভাব ফেলে না। এ কারণে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়, শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কাও বাড়ে। ফলে সে তার সমাজ ও রাষ্ট্রে কার্যকরী অবদান রাখতে পারে না। আর এভাবেই শিশুবিবাহের ফলে শুধু ওই শিশুটি একা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ—সবাই। যে শিশুটি তার পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের তথা সারা বিশ্বের সম্পদে পরিণত হতে পারত; শিশুবিবাহের কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই শুধু ওই শিশুটির জন্য নয়, রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে শিশুবিবাহ বন্ধ করা খুব জরুরি।
গার্গী: আগামী বছরগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়গুলো শিশুদের অধিকারকে প্রভাবিত করবে বলে আপনি মনে করেন? আমাদের কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে? আপনি কি এ বিষয়ে আশাবাদী?
শেলডন: প্রকৃতপক্ষে একটি বা দুটি বিষয় নয়। এখানে অনেকগুলো পরস্পর সম্পর্কিত বিষয় আছে। যেমন দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য, শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা, শিশুবিবাহ, শিশুমাতৃত্ব, নারীর মাতৃত্বকালীন সমস্যা, ইত্যাদি। শিশুর জন্মের প্রথম দুই বছর তাদের মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বিষয়টি চিহ্নিতকরণ, শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হতে হয় এমন অনেক সমস্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লাখ লাখ শিশু আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার হতে যাচ্ছে। আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকার এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে কপ ২৬ পরিবেশ সম্মেলনে একটি বড় প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ যে বুঝতে পেরেছে, এটাও শিশুস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ও দেশের উন্নয়নের জন্য আশাব্যঞ্জক। আমি এ কারণেই আশাবাদী যে বাংলাদেশ এ বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে পারবে।
গার্গী: আপনি কখন প্রথম অনুভব করলেন যে আপনি শিশুদের জন্য কাজ করতে চান? ইউনিসেফের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার কিছু স্মৃতি আপনার কাছে শুনতে চাই।
শেলডন: ইউনিসেফের জন্য কাজ করার আগে আমি সাংবাদিক ছিলাম। পররাষ্ট্র, উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আমি যত বেশি লিখেছি, ততই বুঝতে পেরেছি যে শিশুদের সমস্যাগুলো তাদের জীবনের শুরু থেকেই মোকাবিলা করা দরকার। এগুলো শুধু আর্থিক ভারসাম্য, বাণিজ্যহার এবং মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানবসম্পদ। আরও স্পষ্ট করে বললে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিশু। প্রায় ২৫ বছর আগেই বুঝতে পারি আমাদের জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। ভালো মানের শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে, অন্যথায় আমরা একটি কার্যকর ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির আশা করতে পারব না। তাই শিশুদের সম্ভাবনায় অবদান রাখতে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে শিশুদের জন্য ইউনিসেফে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ইউনিসেফে কাজ করার ফলে আমি সোমালিয়ায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। লাইবেরিয়ায় ইবোলা মহামারি চলাকালে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো নিশ্চিত করার জন্য এবং স্কুলগুলো নিরাপদে আবার খোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অংশীদারদের নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। আমরা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে শিশুদের সহায়তা করছি, কীভাবে আমরা জনস্বাস্থ্যের মৌলিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করছি, কীভাবে আমরা নিশ্চিত করছি যে নারীরা তাদের অধিকার পাবে এবং শিশুরা ভ্যাকসিন পাবে—এ মৌলিক বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেগুলো নিশ্চিত করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করা সত্যিই দুর্দান্ত এক অভিজ্ঞতা।
গার্গী: বিশ্ব শিশু দিবসে বাংলাদেশের শিশু, তাদের প্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকদের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
শেলডন: শিশুদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কথা বলা এবং নিজেদের কণ্ঠকে জোরদার করা। তাদেরকে তাদের প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে কথা বলতে হবে। নীতিনির্ধারকদের নিজেদের কথা শোনাতে হবে। সংসদে আবেদন করতে হবে। শিশুদের প্রয়োজনে সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর অর্থ শুধু স্কুল নয়, মানসম্পন্ন শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে, যেখানে শিশুরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা এবং নির্যাতন ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ। এ পরিবর্তনগুলো আনতে হলে প্রতিটি শিশুকে কথা বলতে হবে এবং নীতিনির্ধারকদের শুনতে হবে প্রতিটি শিশুর দাবি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত