দুই ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর কাজী সুহিন নাহার ধানমন্ডির চারতলা বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। একদিন রাতে ওই ভবনেরই এক বাসিন্দা ফোন করেন সুহিন নাহারের ভাই কাজী শহীদুল আলমকে। সুহিন নাহারের বাসায় তালা।
পাম্প থাকে যে ঘরে তাতেও তালা। পুরো ভবনে পানি নেই। তিনি যদি আত্মীয়স্বজনের বাসায় গিয়ে থাকেন, দ্রুত যেন ফিরে আসেন—মোটামুটি এই ছিল ভাড়াটের বক্তব্য।
ধানমন্ডি ৬/এ সড়কের ৬৯/সি/এ নম্বর ভবনে কাজী সুহিন নাহারের বাসায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করেন কাজী শহীদুল আলম। সেদিন তারিখ ২৩ আগস্ট ২০০৫। রাত ৯টা থেকে বোনের নম্বরে বারবার ফোন করেও তাঁকে পেলেন না কাজী শহীদুল আলম।
খোঁজ নিলেন আত্মীয়স্বজনের বাসাতেও। সুহিন নাহার কারও বাসাতেই যাননি। পেশায় চিকিৎসক কাজী শহীদুল আলম এবার লাশ কাটা ঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। গাড়ি চালিয়ে ঢাকার হাসপাতালগুলোর মর্গে গিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন একটার পর একটা লাশ। সেখানেও নেই। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশকে নিয়ে কাজী সুহিন নাহারের বাসায় গেলেন এবার।
পরদিন পত্রপত্রিকায় ধানমন্ডি থানার পুলিশকে উদ্ধৃত করে খবর ছাপা হয়। তাতে লেখা, সুহিন নাহারের নিখোঁজ থাকার খবরে তাঁর স্বজনদের নিয়ে পুলিশ ধানমন্ডি ৬/এ নম্বর রোডের ৬৯/সি/এ নম্বর বাড়িতে যায়। তৃতীয় তলায় তাঁর ফ্ল্যাটের কলাপসিবল গেট তিনটি তালা দিয়ে আটকানো ছিল। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ডাইনিংয়ের মেঝেতে সুহিন নাহারের গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। পর্দার কাপড় দিয়ে তাঁর মৃতদেহ ঢাকা ছিল। ওই রাতেই কাজী শহীদুল আলম বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় সুহিন নাহারের সাবেক গৃহপরিচারক ‘শরিফ’কে আসামি করে মামলা করেন।
আনুষঙ্গিক আরও কিছু তথ্যও পুলিশকে জানান কাজী শহিদুল আলম। সুহিন নাহার ছয় ভাইয়ের একটিই বোন। তাঁদের বড় ভাই সামসুল আলম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসরে গেছেন। কাজী শহিদুল আলম সোহরাওয়ার্দী ও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। অন্য ভাইয়েরাও প্রতিষ্ঠিত।
১৯৮৮ সালে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় সুহিনের। প্রখর আত্মসম্মান বোধ থেকে ভাইদের বাসায় থাকতে রাজি হননি। দুই ছেলেকে নিয়ে ধানমন্ডির ওই বাড়িতে থেকে যান।
বাড়িটা তাঁর নামেই ছিল। ছেলেরা বিদেশে পড়তে যেতে চাইলে বাড়িটা ছেলেদের নামে লিখে দেওয়ার শর্তে সাবেক স্বামীর থেকে পড়ার খরচ নিতেন। তত দিনে তাঁর সাবেক স্বামী আবার বিয়ে করেছেন। মামলা শরিফের নামে হলেও কাজী শহিদুল আলমের আরজি ছিল কাউকেই যেন সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা না হয়। তবে তাঁর এই কথা পুলিশ কানে নেয়নি বলে অভিযোগ কাজী শহিদুল আলমের।
প্রায় ১৬ বছর আগের এই হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গত ৩১ মার্চ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। অবশ্য সিআইডির বিশেষ সুপার মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা আসামি শনাক্ত করেছেন, কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আসামিকে পাওয়া গেলে আবার মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হবে। তবে আদালত এখনো এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করেননি। আসামি গ্রেপ্তারে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি বলেও দাবি করেন তাঁরা।
সূত্রগুলো বলছে, বহু হাত ঘুরে মামলাটি পায় সিআইডি। প্রথম দুই বছর মামলাটি ছিল ধানমন্ডি থানায়। এই সময়ে তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে সাতবার। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে ছয়-সাত বছর ছিল মামলাটি, দায়িত্ব পেয়েছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও। আসামি গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয় সবাই। এর মধ্যে ডিবি সন্দেহভাজন আসামি ‘শরিফ’কে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০১৭ সালে সিআইডি তথ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে সন্দেহভাজন আসামির ছবি প্রচারে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কে এই শরিফ? সিআইডি কেনই বা খুঁজে পেল না তাকে?
কাজী সুহিন নাহার হত্যাকাণ্ডের পরদিন পত্রপত্রিকার বিবরণের সঙ্গে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। তাঁরা বলেন, সুহিনের একজন বান্ধবী ছিলেন, নাম সেলিনা হোসেন রত্না। একজন গৃহকর্মী শরিফকে নিয়ে এসেছিলেন সেলিনার কাছে। তার বয়স তখন ছয়-সাত বছর, অসহায় ছেলে, আশ্রয় খুঁজছিল। মাস দুয়েক তাঁর কাছে থাকার পর ছেলেটিকে সুহিন নাহারের কাছে দিয়েছিলেন। আদর-যত্ন করেই বড় করছিলেন সুহিন নাহার। ছেলেরা বিদেশে চলে যাওয়ার পর শরিফকে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বিয়েতেও গেছেন। এ নিয়ে কেউ কেউ আপত্তিও করতেন। সুহিন কানে নেননি সেসব কথা। শরিফ বড় হয়ে গেলে তাঁকে কাজ খুঁজে নিতে বলেন সুহিন নাহার। সে চলেও যায়। হত্যাকাণ্ডের সাত দিন আগে শরিফ আবারও ঢাকায় আসে। আগের রাতে ছিলও ওই বাসায়।
ওই ভবনের বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, যে দিন সুহিন নাহারের মৃতদেহ উদ্ধার হয়, ওই দিনই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুটো বস্তা হাতে শরিফকে তাঁরা বেরিয়ে যেতে দেখেন। ওই ভবনের এক গৃহকর্মী শরিফকে জিজ্ঞেস করেন সে কোথায় যাচ্ছে। জবাবে শরিফ বলে, সুহিন নাহারের ভাইয়ের বাসায়। এরপর ওই এলাকায় তাকে আর কেউ দেখেনি।
সুহিন নাহারের বান্ধবী সেলিনা হোসেনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, বাসা থেকে শরিফের ছয়-সাত বছরের একটা ছবি পাওয়া গিয়েছিল। ওর বাড়ি কিশোরগঞ্জ, এ টুকুই জানতেন তাঁরা। সুহিন নাহার হয়তো বিস্তারিত জানতেন। কিন্তু তিনি কাউকে বলে যাননি, যদিও গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যই টুকে রাখার অভ্যাস ছিল তাঁর।
শরিফ, বাড়ি কিশোরগঞ্জ। এই তথ্য হাতে নিয়ে সিআইডি তদন্তে নামে। জাতীয় নিবন্ধন পরিদপ্তরে যোগাযোগ করে সিআইডি কিশোরগঞ্জে ৩ হাজার ২৫০ জন শরিফকে পান। শরিফ নামধাম লিখতে পারতেন এ খবর জেনে সিআইডি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা এমন ৩৫০ জনকে খুঁজে বের করেন। যাচাই-বাছাইয়ে তালিকাভুক্ত করেন ৭৯ জনকে, সেখান থেকে ১৭ জন ও সবশেষে ৪ জন। ২০০৫ সালে ১৬-১৭ বছর বয়স হলে, তাঁর চেহারা কেমন হতে পারে, সেই ধারণা থেকে শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকান তাঁরা। কিছুটা মিল আছে বলে যে চারজনকে আলাদা করেছিলেন, তাঁরা কেউ ঢাকায় যাননি কখনো। তাকে যে গৃহকর্মী সেলিনা হোসেনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর বাড়ি বরিশাল হতে পারে বলে শুনেছিলেন সিআইডি, তাঁরা সেখানেও গিয়েছেন।
শরিফের মাকেও খুঁজেছেন গাজীপুরে। অবশেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সুহিন নাহারের ভাই কাজী শহিদুল আলম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার খবর জানতেন না। বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় আক্ষেপ ঝরে পড়ল কথায়। বললেন, পুলিশ শুধু ঘুরেফিরে তাঁর কাছে এসেছে। গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি, সময় নষ্ট করেছে। আফসোস করা ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার নেই।
সুহিন নাহার যেখানে থাকতেন, বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে জানা যায়, ফ্ল্যাটটিতে তাঁর সাবেক স্বামীর বোনঝি থাকেন। বাসায় গিয়ে দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা দেননি।