কয়েক বছর আগে ক্লাসে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দিন দিন আমার কাছে কষ্টকর হয়ে উঠছে। যদিও তখন এখনকার মতো রেগুলার শিক্ষকতা করিনি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ানোর সুবাদে একটি ক্লাসে ঘোষণা দিয়েছিলাম পরের ক্লাসে কুইজ টেস্ট নেওয়ার। সপ্তাহান্তে পরীক্ষার দিন এলে ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় এক ছাত্রী ফোন করে অনুরোধ করে বলে ‘স্যার টেস্ট যদি ক্লাসের শেষের দিকে নেন তাহলে আমি পরীক্ষাটা দিতে পারি’ (যেহেতু এই টেস্টগুলো পুনরায় দেওয়া যায় না)। কোনো কারণ জিজ্ঞেস না করেই রাজি হয়ে যাই।
পরদিন ক্লাসে এসে যথারীতি দেখতে পাই ক্লাসময় পরীক্ষার জোর প্রস্তুতি। বললাম, পরীক্ষা নিয়ে এত ব্যস্ততার কিছু নেই, তোমাদের প্রথমে একটু পড়িয়ে নিই। শেষের দিকে পরীক্ষাটা নেব। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসজুড়ে ঘোর বিরোধিতা ‘প্লিজ স্যার, পরীক্ষাটা নিয়ে নেন আগে, ইত্যাদি’। বললাম, তোমাদের এক বন্ধুর একটু অসুবিধা আছে, ওর জন্য একটু অপেক্ষা করে নিতে চাই, যেহেতু আগে থেকেই অনুরোধটা করেছে। উত্তর এল, ‘কোন বন্ধু স্যার? কার বন্ধু স্যার? আমরা সবাই তো আছি স্যার।’ নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে তোমাদের না হয় কোনো বন্ধু নেই, মনে করো আমিই পরীক্ষাটা ক্লাসের শেষে নেব, অসুবিধা আছে? ‘জি স্যার, অসুবিধা আছে, কারণ পরীক্ষার পড়া মাথায় রেখে আপনার ক্লাস করলে ভুলে যাব সব...পরীক্ষায় লিখতে পারব না তেমন কিছুই।’
স্তম্ভিত হয়েছিলাম, প্রথমত বন্ধুত্বের প্রতি অনীহা দেখে। আর দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অমানিশা দেখেছিলাম দ্বিতীয় কারণটি জেনে! ভুলে যাবে তারা মুহূর্তেই খাতায় লিখে? তাহলে এ শিক্ষা তারা সারা জীবন কোথায়-কীভাবে কাজে লাগাবে? সুপরিচিত নকল পদ্ধতির সঙ্গে এ রকম ক্রমাগত ডিলেটেশন পদ্ধতির পার্থক্য কী?
অপ্রাপ্তিকে এভাবে উদ্যাপন করার উদাহরণ খুব কমই আছে বোধ করি অন্য কোনো ব্যাপার নিয়ে। শিক্ষা তো আর মাটিকাটা নয় যে ১০০ মিটার করে কেটে কেটে একদিন ১০০০ মিটার হয়ে যাবে। আমরা সিলেবাস টুকরো টুকরো করে কেটে কেটে শেষ করার ভেতর দিয়েই শিক্ষিত বানানোর দায়িত্ব শেষ করি! অথচ শিক্ষা হলো সামগ্রিকভাবে মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী জ্ঞান ও জীবন দক্ষতার উন্মেষ। অথবা বলা যায়, সবকিছু মনে না থাকলেও শিক্ষার্থী যখন কিছু কিছু শিক্ষা মনে রাখতে পারে অনেক দিন ধরে। অথবা শুধু মনেই রাখে না বরং করে ফেলতে পারে কিছু একটা—শিক্ষকের চেয়ে বেশি অনায়াসে, সেই কামনা ও চেষ্টাই আমাদের মুখ্য হওয়ার কথা।
পাস করা এবং করানোর গুরুত্বটা এত বড় করে দেখার ভেতরেই আছে নানা দুর্নীতি। জ্ঞান তথা দক্ষতা বৃদ্ধি লক্ষ্য না হয়ে যদি লক্ষ্য হয় নম্বর অথবা গ্রেড, তবে সেই গ্রেড বা নম্বরের লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কত কী–ই না ঘটে যেতে পারে। সঠিক গবেষণা হলে যার ভেতরে এসে যাবে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে নানা ধরনের একাডেমিক এবং আর্থিক দুর্নীতি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানি, র্যাগিং, হত্যা, আর্থিক দুর্নীতি, নিয়োগ দুর্নীতি, ভর্তি দুর্নীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমাজের সবাই তুমুল সোচ্চার হলেও একাডেমিক দুর্নীতি নিয়ে তেমন কোনো কথা ওঠে না। কারণটা কি বোধের অভাব? নাকি অন্য কিছু? খুঁজে বের করা খুব জরুরি।
খাতায় লিখে ভুলে যাওয়ার জন্য যারা শেখে, তারা তো বেকারই থেকে যাওয়াই কথা। বেকারত্ব হয়তো অন্য কোনো দুর্নীতির মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় কারও কারও ক্ষেত্রে। কিন্তু দেশে মূল জনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে একদিন যদি ভুল শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতিটা না বুঝি, অশিক্ষাকে শিক্ষার অংশ করে দিতে পারলে সেই জাতিকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো অতি সহজ বটে।
ক্ষেত্রবিশেষে এটাও বলতে শুনেছি নামীদামি শিক্ষকের মুখে, ‘আমি মিডটার্ম পরীক্ষার আগে পড়ানো অংশগুলো ফাইনালের সিলেবাসে রাখি না’। বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছি, ‘কেন স্যার?’ উত্তর এসেছে, ‘সীমিত সিলেবাসে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট ভালো হয়, ওগুলো তো হয়ে গিয়েছে, শুধু শুধু মাথায় এত চাপ রেখে লাভ কী?’ প্রশ্ন হলো, মাথার চাপ কমাতে গিয়ে আমরা কি দিন দিন জাতীয় চাপ বাড়াচ্ছি না তথাকথিত শিক্ষিত বেকার তৈরি করে? তারা আসলে কি ভালো শিক্ষার্থী? নাকি আমরা ভালো শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রণেতা? যে শিক্ষার্থী কয়েকটা মাস তার অর্জিত শিক্ষা মনে রেখে পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা দিতে অক্ষম, সে ভালো শিক্ষার্থী হয় কী করে? অথবা কর্মযোগ্যতাসম্পন্ন দক্ষ মানুষ হবে কী করে? সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ, দুর্নীতির অভিযোগ এবং সঙ্গে গবেষণার দাবি রাখে যেখানে।
‘পরীক্ষার ভয়ে কিছুটা হলেও পড়াশোনা হয়’ এই যুক্তিতে একদল শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থী একমত বলেই, শুধু পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন ও সনদ প্রদানের কার্যক্রম সারা পৃথিবীতেই চলছে দেদার। যে পদ্ধতিতে একটা অংশের শিক্ষার্থীরা সফলকাম হলেও বিশাল অংশের শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়ে যাচ্ছে এবং যাবে আগামী দিনে। সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুর্নীতি সেখানেই। দুর্নীতি আছে গবেষণার নামেও। অনেকেই আছেন শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা সময় খরচ করে নিজের ব্যক্তিগত গবেষণা করেন, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ‘প্রমোশন’।
সমস্যা হাজারটা হলেও উপায় কিন্তু একটাই। নিজেকে ভালোবেসে শিখতে শেখা। ভালোবাসার সঙ্গে, যেখানে অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে শিক্ষকের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, শিক্ষাদর্শনের এবং শিক্ষানীতির।
লেখক: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জেনারেল এডুকেশন ডেভেলপমেন্টের বিভাগীয় প্রধান ও স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর