শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মতপ্রকাশের চর্চা নিশ্চিত হোক

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবং করণীয় সম্পর্কে বলেছেন তিন বিশিষ্ট নাগরিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাশেদা কে চৌধূরীআবদুল জব্বার খান। তাঁরা বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মতপ্রকাশের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এটা মতপ্রকাশের ওপর আক্রমণ: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বুয়েটের ঘটনা অপ্রত্যাশিত, হৃদয়বিদারক ও হতাশাজনক। এটা কোনো সাধারণ অপরাধের ঘটনা নয়। এটাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলা যাবে না, এটা সরাসরি আক্রমণ। কেননা, মত প্রকাশ করতে গিয়ে ছাত্রটি প্রাণ হারিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কারখানা নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র। সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে কোথায় থাকবে? বুয়েটে যারা পড়তে যায়, তারা আমাদের সেরা ছেলেমেয়ে। অগ্রসর চিন্তা তো তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত।

শিক্ষার্থীর অপরাধ ছিল সে জাতীয় বিষয়ে মত প্রকাশ করেছে। জাতীয় বিষয়ে মত প্রকাশের চর্চা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঘটে, তাহলে কোথায় ঘটবে? আবার এটাও স্মরণীয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস হওয়ার কথা সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সেখানে যদি শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা না পায়, তাহলে কোথায় পাবে?

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ছাত্রসংসদ নেই। ছাত্রসংসদ যদি থাকে, যদি নিয়মিত নির্বাচন হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা ও মেধা বিকাশের সুযোগ ঘটে। সেই সুযোগ অনেক দিন ধরে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সমিতি আছে। তাঁরাও তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি থাকার কথা ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে। সেটা এখন দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি, মাদকাসক্ত ও খুন-জখমসহ সব রকমের অপরাধ ঘটছে। এমনকি প্রশাসনও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছে। এগুলো উন্নতির লক্ষণ নয়, নিম্নগামিতার নিদর্শন বটে।

 বুয়েটের ছাত্র হত্যার ঘটনাটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার, এমনটি বলা যাবে না। দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেভাবে সংকুচিত হচ্ছে, সমাজে পরমতসহিষ্ণুতা ও নৃশংসতা যেভাবে বাড়ছে, এটি তারই একটি অতি নির্মম ও অমানবিক উন্মোচন। বিশ্ববিদ্যালয় হবে সমাজের পথপ্রদর্শক। পথপ্রদর্শক না হয়ে সে যদি সমাজের ক্রমবর্ধমান অন্ধকারেরই প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে আমরা আশা রাখব কোথায়?

অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো আমরা চাইবই। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও চাইব যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বই প্রধান। কারণ, ক্ষমতা রয়েছে তাদের হাতে এবং সমস্যাটা যে আইনশৃঙ্খলার তা নয়, গণতন্ত্রচর্চা ও গণতন্ত্র রক্ষা করারও।

*সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

রাশেদা কে চৌধূরী

উন্নয়নের সব গর্ব মিলিয়ে যাচ্ছে: রাশেদা কে চৌধূরী
দেশ সবকিছুতে এগোচ্ছে বলে আমরা গর্ব করছি। উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার গর্ব করছি। উন্নয়নের সব গর্ব মিলিয়ে যায় এভাবে একজন মেধাবী ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে অত্যাচার করে মেরে ফেলার ঘটনায়। এ ঘটনায় আমরা ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত দুটি কারণে। এক. রাষ্ট্র যখন স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করে না, তখন কার কাছে যাব? দুই. ভিন্নমত প্রকাশ করায় একজন তরুণকে যদি প্রাণ দিতে হয়, তাহলে আমি কী করব?

আমরা এমন উন্নয়ন চাই না, যা অন্ধকারকে ঠেকাতে পারে না। একসময় নতুন প্রজন্ম আমাদের প্রশ্ন করবে, তোমাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব ঘটনা কীভাবে ঘটেছে?

আমাদের লাখ লাখ সন্তান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ছে। মায়ের বুক খালি হচ্ছে, কিন্তু যেসব মায়ের সন্তানেরা এটা করে, সেই অভিভাবকেরা কী করছেন? তাঁদের সন্তান কেন বন্য প্রাণীর মতো হিংস্র হচ্ছে? এ জন্য তাঁদেরও দায় আছে।

প্রশ্ন ওঠে, আবাসিক হলে টর্চার সেল থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা জানত কি না। মোটকথা অন্যায় করলে কিছু হবে না, এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমার অনুরোধ, আইনজীবীরা যেন অর্থের লোভে চিহ্নিত অপরাধীদের পক্ষে না দাঁড়ান। আবরারের মা-বাবার কথা চিন্তা করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে তাঁরা যেন আইনি লড়াই করেন।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম কিছুদিন হইচই করবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুদিন তৎপর থাকবে। এরপর সবকিছু চলবে আগের মতোই।

সবাই, সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি। এর কারণ আইন বা নিয়মকানুন কাজ করে না। অপরাধী যে–ই হোক ছাড়া পাবে না—সরকারের এই মনোভাব কিন্তু দলের বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যদি পৌঁছে থাকে তাহলে কি তারা সরকারপ্রধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে? সরকারপ্রধান কোথাও কি বলেছেন ভিন্নমত প্রকাশ করা যাবে না?

আমরা যে প্রজন্মের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখনকার ছাত্ররাজনীতিতে এগুলো দেখিনি। ধীরে ধীরে পদস্খলনের জায়গায় চলে গেলাম। কিন্তু কলুষিত ছাত্ররাজনীতি তো আমরা আর চাই না। আর তা না চাইলেও ছাত্ররাজনীতির নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ধর্ষণ তো চলছেই।

*রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

আবদুল জব্বার খান

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকার দরকার নেই: আবদুল জব্বার খান
বুয়েটে যে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, এর চেয়ে দুঃখজনক ও মর্মান্তিক আর কিছু হতে পারে না। এসব ঘটনা মেনে নেওয়া, সহ্য করা খুব কঠিন। সহপাঠীর হাতে এভাবে আবরারের বর্বর হত্যাকাণ্ডে মন ভেঙে গেছে। বুয়েটের একজন ছাত্র, অ্যালামনাই এবং শিক্ষক হিসেবে নিজেকে খুব অসহায় মনে করছি।

এ পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়, বুয়েটে কোনো ছাত্ররাজনীতি থাকার দরকার নেই। এখানকার শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষক সমিতি বা অ্যালামনাইরাও এই রাজনীতির প্রয়োজন আছে বলে অনুভব করছেন না। বুয়েট অধ্যাদেশে বলা আছে, সেখানে ছাত্র সংসদ (ইউকসু) থাকবে। ছাত্ররাজনীতি থাকার কথা বলা নেই। সেখানে ইউকসু ভবন আছে, কিন্তু ছাত্র সংসদ নেই। সনি হত্যার পর থেকে ইউকসু নির্বাচনের উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি।

শুধু পড়াশোনার মাধ্যমে একজন ছাত্র সুনাগরিক হতে পারে না। ছাত্রদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকতে হবে। ছাত্রদের এই যুক্ততার পথ খোলা রাখার গেটওয়ে হতে পারে ইউকসু। এই নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশ নেওয়া যায় না। আমরা যখন বুয়েটের ছাত্র ছিলাম, নির্বাচনটা ছিল উৎসবের মতো। অথচ গণতন্ত্রচর্চার এই সুষ্ঠু জায়গাটি রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এর ফলে প্রশাসন ও শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বেড়েছে।

বুয়েটের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, একজন ছাত্র অপরাধ করলে তাকে গুরু ও লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ শাস্তি বহিষ্কার করা। কিন্তু বহিষ্কারের পর অনেকে আইনের আশ্রয় নেয়। তখন আদালত শাস্তি স্থগিত করেন। এই সুযোগে অনেকে পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যান। ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরু বা লঘু শাস্তি কাজে লাগে না।

একেকটি ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। এরপর সবকিছু থেমে যায়। ২০০২ সালে সাবেকুন্নাহার সনি হত্যার পর উত্তাল পরিস্থিতিতে তদন্ত কমিটি হলো। কমিটি সুপারিশ করল। কিন্তু সব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৩ সালে আরিফ রায়হান দীপকে কুপিয়ে হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কমিটি করেছে বলে আমার জানা নেই। আবরারের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। এই হত্যার পেছনে বুয়েট প্রশাসনের অবহেলা ও দায় তো আছেই। এখন সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচারের জন্য অপেক্ষা।

*আবদুল জব্বার খান: সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য।