শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ৮১ শিক্ষক এক বিবৃতিতে আজ বুধবার এ দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধন-উৎসবের ডামাডোলে ঢাকা পড়ে গেছে অন্তত দুটি ঘটনা। এ দুই ঘটনা শিক্ষাঙ্গনের জন্য অশনিসংকেত। দুটি ঘটনায় শিক্ষক হিসেবে আমরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষের গলায় পরানো হয়েছে জুতার মালা। আর সাভারে এক স্কুলশিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তাঁরই এক ছাত্রের বিরুদ্ধে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। তাতে ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। স্বপন কুমার পরিস্থিতি বুঝে অভিযুক্ত ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে অধ্যক্ষ ছাত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এতে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তখন স্থানীয় বাসিন্দারাও কলেজে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে। সে সময় কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি)। তাঁদের সঙ্গে ছিল ২০০ থেকে ২৫০ পুলিশ সদস্য।
১৮ জুনের এ ঘটনায় পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ে এভাবেই অপমানিত হন। ছাত্র এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে আর অধ্যক্ষ নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। এ-বাড়ি ও-বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করছেন। এও জানা যাচ্ছে, তাঁকে পদচ্যুত করে আরেকজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে ২৫ জুন সাভারের আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, স্কুলের মেয়েদের ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে ছাত্রটি হঠাৎ শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে।
আহত উৎপল কুমার পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৬ বছর বয়সী ছাত্রটি স্কুল কমিটির এক সদস্যর আত্মীয়। ছাত্রকে পুলিশ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়েও দিয়েছে। অথচ বিষয়টি হত্যাকাণ্ড! এক ছাত্র হত্যা করেছে এক শিক্ষককে।
অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের আচরণটি শিক্ষক বা নাগরিকসুলভই ছিল।
তিনি ছাত্রকে জনতার হাতে ছেড়ে না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। যদি সে কোনো অপরাধ করে থাকে, প্রচলিত আইনে বিচার হবে। কিন্তু তিনি ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন, এ গুজবের কারণে তাঁকে এমন অপমানিত হতে হলো। প্রভাষক উৎপল কুমার স্কুল ও কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন, দায়িত্বের অংশ হিসেবেই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের তাঁর শাসন করতে হতো, তাদের অন্যায়-অপকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে হতো। ছাত্রটির বিরুদ্ধে শিক্ষক উৎপল কুমারের শৃঙ্খলাজনিত পদক্ষেপ নেওয়ার কারণেই সে বিক্ষুব্ধ ছিল।
বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো উচ্ছৃঙ্খল জনতার বা কখনো বিক্ষুব্ধ ছাত্র দ্বারা আক্রান্ত-অপমানিত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণ করছেন। শিক্ষকদের যে সম্মান এই সমাজ দিত একসময়, আজকাল তা তো অপসৃতই, সঙ্গে জুটছে সহিংসতা, এমনকি মৃত্যুও। আজ এমন এক সমাজ-রাষ্ট্র দেখা দিয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে যেনতেন রকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
তা দিয়ে কেরানি-আমলা হবে, কিন্তু শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য, জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের লালন, সেসবের অস্তিত্ব যেন নেই সেখানে। শিক্ষকদের প্রাপ্য মূল্য-মর্যাদা দিচ্ছে না আজকের সমাজ।
এর আগে এ বছরের এপ্রিল মাসে মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ক্লাসের আলোচনাকে গোপনে ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছিল তাঁরই ছাত্র। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি ইসলাম অবমাননা করেছেন। এ কারণে ওই শিক্ষককে কারাবাস করতে হয়। এরও আগে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সবার সামনে কান ধরে ওঠবস করান স্থানীয় সংসদ সদস্য। স্পষ্টভাবে বলা ভালো, সারা দেশেই মুসলমানদের অনুভূতি নিয়ে কতিপয় গোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতা বিস্তারের অপচেষ্টা ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। এর মাধ্যমে ক্লাসরুম থেকে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। অল্পতেই তাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
কিন্তু অনুভূতি যতই নাজুক হোক, তার প্রতিক্রিয়া খুবই আগ্রাসী। প্রতি পূজায় এবং সারা বছর ধরে নানান সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে বাংলাদেশে। সামান্য এক ব্যক্তির ফেসবুকের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় একটি পুরো এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়ে থাকে।
সংখ্যাগুরুর দাপটে ‘সংখ্যালঘু’ জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। তারা যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। দেশের সংবিধান-আইনকানুনে যা–ই লেখা থাক, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদেরা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের’ পক্ষেই কাজ করে চলেছে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক কিছু দাবি জানিয়েছে। এগুলো হলো—
*প্রভাষক উৎপল কুমারের হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুততম সময়ে করতে হবে। পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। জানা গেছে, বাদী এজাহারে আক্রমণকারী ছাত্রের বয়স ১৬ উল্লেখ করলেও তার প্রকৃত বয়স ১৯।
*অধ্যক্ষ স্বপন কুমারকে সসম্মানে স্বপদে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে তার হৃত সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা ওই অধ্যক্ষকে অপমানের আয়োজন করেছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
*সারা দেশে ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনকে নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। আর ধর্মের নামে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, রাজনীতিবিদ বা স্থানীয় উন্মত্ত মানুষের দাবিকে অগ্রাহ্য করে প্রচলিত আইন, মানবিক অধিকার, কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে হবে এবং দেশে সব ধর্ম ও মতের মানুষের জন্য উদার, অনুকূল ও সহনশীল পরিবেশ তৈরিতে প্রশাসনসহ সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে।