কৃষক পরিবারের ছেলে লিমন হোসেন। তখন ১৬ বছরের কিশোর। উচ্চমাধ্যমিক শুরুতে র্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছেন। বিচারের বদলে সহ্য করেছেন নির্যাতন। তাঁকে সন্ত্রাসী প্রমাণের চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যাননি। অদম্য সেই লিমন এখন ২৫ বছরের যুবক। ঢাকার উপকন্ঠ সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) আইন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।
কিন্তু গত ৯টি বছর ছিল লিমনের জন্য চরম যন্ত্রণার। ছিল সন্ত্রাসী পরিচয়ের যন্ত্রণা, কাটা পা নিয়ে নিজেকে বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা। মাসে মাসে আদালতে হাজিরার যন্ত্রণাও ছিল।
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল লিমনের চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। সেই দুঃসহ পরিস্থিতিকে পায়ে দলে এগিয়েছেন লিমন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকেও পড়ালেখা করেছিলেন। সঙ্গে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি পরিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে কৃতকার্য না হওয়ায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে আইন বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাতুরিয়ায় নিজের বাড়ির পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন লিমন। বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে র্যাব সদস্যরা এক সন্ত্রাসীকে ধরতে গিয়ে তাঁকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। তারপর লিমনকে প্রথমে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। জীবন বাঁচাতে সেখানে তাঁর বাঁ পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়।
এ ঘটনার পর র্যাব লিমনসহ আটজনের নামে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করে। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে।
এরপর ওই বছরের এপ্রিলে লিমনকে নিয়ে খবর ছাপে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এতে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক প্রতিবাদ উঠেছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের দেওয়া সব অপবাদ অসত্য প্রমাণ করে লিমন নতুন জীবন ফিরে পান। পা হারানো লিমনকে রাষ্ট্রীয় হয়রানির কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়।
রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার শিকার তরুণ লিমন পিজিএস কাউখালী কারিগরি বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৭ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং ২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। সম্প্রতি ১০ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
লিমন হোসেন বলেন, ‘আমি অন্ধকার এক গুহায় আটকে গিয়েছিলাম।’ আইনের প্রভাষক লিমন হোসেন বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের কাছে যতটা নির্যাতিত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি মানুষের স্নেহ, সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি।’
শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি লিমন হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের মূল লক্ষ্য অসহায়, নির্যাতিত মানুষের জন্য কাজ করা। তাদের পাশে থাকা। বাংলাদেশে মানুষকে কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, আমার চেয়ে ভালো কেউ বর্ণনা করতে পারবেন না। স্বপ্ন দেখতে মানা নেই। আমিও স্বপ্ন দেখছি, এরপর আমি ব্যারিস্টারি পড়তে চাই।’