মানবদেহ স্ক্যানার, বিস্ফোরকদ্রব্য নির্ণয় যন্ত্রসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছয় মাসের মধ্যে আধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম আসছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নয়নে ৫৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় এসব সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। এর বেশির ভাগ অর্থের জোগান দিচ্ছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। এ ছাড়া র্যাঙ্কিংয়ে ব্যাপক উন্নয়নের পর বিমানবন্দরের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থার আধুনিকায়নের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বা সিভিল এভিয়েশন অথোরিটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, র্যাঙ্কিংয়ে নির্ধারিত মানদণ্ড থেকে ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকা ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একসময় কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। দুই বছর আগে র্যাঙ্কিংয়ে বড় অঙ্কের লাফ এখন এই বিমানবন্দরকে দাঁড় করিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চসংখ্যক পয়েন্ট প্রাপ্তের তালিকায়।
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। ফ্লাইটে নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে ২০০৯ সালে বেবিচক দ্বিতীয় ক্যাটাগরির নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য দেশটিতে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। তবে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) অডিট প্রতিবেদনে এভিয়েশন কান্ট্রি র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে।
এই উন্নতি ধরে রাখতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে বেবিচকের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী অ্যাভসেকের (এভিয়েশন সিকিউরিটি) জনবল বৃদ্ধি, অত্যাধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব সরঞ্জাম দেশে এসে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে বেবিচক।
ক্যাটাগরি-২-এ নেমে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অথোরিটি (এফএএ) ক্যাটাগরি-১-এ উন্নীত হওয়ার জন্য বেবিচকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, কাঠামো অনুযায়ী জনবল নিয়োগসহ কিছু শর্ত দেয়। সব বিষয় নিয়ে যখন কাজ চলছিল, তখনই আসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যের কার্গো পণ্য পরিবহনের নিষেধাজ্ঞা।
এরপর মান উন্নয়নে কাজ শুরু করে কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইকাও কারিগরি কমিটির অডিট টিম আসে বাংলাদেশে। তারা পর্যবেক্ষণ করার পর যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ৭৭ দশমিক ৪৬ পয়েন্টে উঠে আসে। এটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালে ছিল ৫০ দশমিক ২। অথচ একটি মানসম্মত বিমানবন্দরের র্যাঙ্কিং ধরা হয় ৬০ পয়েন্ট।
এ প্রসঙ্গে অ্যাভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে আইকাও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা, পেশাদারি ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে। এর আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সবশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে আইকাও। নিরাপত্তার দিক দিয়ে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭০ এবং সার্বিক বিবেচনায় ৭৭ দশমিক ৪৬। র্যাঙ্কিংয়ে সর্বোচ্চ পয়েন্ট সিঙ্গাপুরের, ৮৫। এ ছাড়া ৮০ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে দুবাই।
অ্যাভসেক সূত্রে জানা গেছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ১৯৬৬ সালের নকশায় তৈরি। এটার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১৯৮০ সালের পর। বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত বিষয় প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো। বিমানবন্দরের উন্নয়নে ২০১৬ সালে তারা কাজ শুরু করে। সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ বাস্তবায়নে সাফল্য এসেছে। এখনো বেশ কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের অপেক্ষায় এবং আরও নতুন কিছু বাস্তবায়ন করা হবে। আইকাও মানদণ্ড অনুসারে বিমানবন্দরের চারপাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী হতে হবে কমপক্ষে ২ দশমিক ৮ মিটার উঁচু। শাহজালাল বিমানবন্দরে নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হয়েছে ৪ দশমিক ৬ মিটার উঁচু। আগে ব্যাগেজ স্ক্যানার যন্ত্রে সিঙ্গেল ভিউ বা এক পাশ দেখা যেত। এখন ডাবল ভিউ, দুই পাশ দেখা যায়। আর্চওয়ে যন্ত্রগুলো আধুনিক করা হয়েছে। বিমানবন্দরের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ সিস্টেমের ১৯টি ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
অ্যাভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, অ্যাভসেক আড়াই শ সদস্যের। দুই বছর আগে এ সংখ্যা আড়াই হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা সরঞ্জামের মধ্যে চারটি হিউম্যান বডি স্ক্যানার এবং এক্সপ্লোসিভ ডিটেকটিভ সিস্টেম (ইডিএস) দিচ্ছে জাইকা। এ ছাড়া বিভিন্ন মালামাল পরিবহনে ডাবল কেবিন পিকআপ কেনা হচ্ছে। ‘আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসমূহের সিকিউরিটি ব্যবস্থা উন্নয়ন’ শিরোনামের ৫৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় এসব সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। এ প্রকল্পে জাইকা দিচ্ছে ৫৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। বাকি টাকা বেবিচকের নিজস্ব তহবিল। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে।
নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির কারণে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্য কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই, এটাই আমার লক্ষ্য।’
সরকার আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই বেবিচককে দ্বিতীয় ক্যাটাগরির নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে প্রথম ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা আমরা ঠিক করি না। আইকাওর পরামর্শে ঠিক করা হয়। যেসব সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে, তাতে জাইকা অর্থ দিচ্ছে। জাইকা দরপত্র আহ্বান করবে এবং সরঞ্জাম কিনে হস্তান্তর করবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে সরঞ্জামগুলো আসবে। এখন যে ইডিএস আছে, তা দিয়ে শুধু ইউরোপে যেসব কার্গো যায় সেসব স্ক্যান করতে পারি। নতুনগুলো দিয়ে যেকোনো দেশের কার্গো স্ক্যান করা যাবে।’
বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাঈম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ৭০ শতাংশ না ১০০ শতাংশের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের বিমানবন্দরের সুরক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে আইকাও কথা বলেছে। পাসপোর্ট হারালে কী ব্যবস্থা আছে। এসবি কী কাজ করে। আগুন লাগলে কী ব্যবস্থা আছে। তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে আমাদের ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থা যেন আরও উন্নত করা যায়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’