থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন

শাফি-রাফিরা তাকিয়ে আছে আপনার দিকে

মায়ের সঙ্গে বিল্লাল। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত সে। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে বিল্লাল। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত সে। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর মুগদার বামহিউদ্দিন মাহমুদের দুই ছেলে। বড় ছেলে শাফিউদ্দিনের বয়স ১২ বছর। আর ছোট ছেলে রাফি উদ্দিনের বয়স ৭ বছর। দুই ছেলেরই জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে মহিউদ্দিন জানতে পেরেছেন ছেলেদের শরীরে ঘাপটি মেরে বসে আছে থ্যালাসেমিয়া। তারপর থেকেই রক্তের সন্ধানে এই বাবাকে দৌড়াতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আজ বুধবার বেলা দুইটার দিকে এই বাবার সঙ্গে টেলিফোনে যখন কথা হয়, তখন তিনি বলেন, ‘বড় ছেলের রক্তের সন্ধানে বের হয়েছি। দুই ছেলের রক্তের গ্রুপ দুই রকম। মাসের ভিন্ন সময়ে দুই ছেলের শরীরে রক্ত দিতে হয়। করোনাভাইরাসের এই সময়ে রক্তের ডোনার পাওয়া, শরীরে রক্ত দিতে হাসপাতালের সিরিয়াল পাওয়াসহ সবকিছুই কঠিন হয়ে গেছে। অন্যদিকে দুই ছেলেকে বাঁচাতে চাইলে রক্ত তো দিতেই হবে।’

মহিউদ্দিন একটা ব্যবসা করতেন। নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য এখন সে ব্যবসাও বন্ধ। সংসার ও ছেলেদের চিকিৎসা খরচ দিচ্ছেন মহিউদ্দিনের ভাইবোনেরা। মহিউদ্দিন জানান, দুই বছর ধরে তিনি বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ফাউন্ডেশন বর্তমানে তাঁর দুই ছেলের ওষুধের খরচটা দিচ্ছে। ফলে একটু শ্বাস নিতে পারছেন। কেননা, দুই ছেলের ওষুধের পেছনেই আগে খরচ করতে হতো বিশাল অঙ্কের টাকা। করোনাভাইরাসের বিস্তারে ফাউন্ডেশনেও সেবার পরিসর সীমিত হওয়ায় হাসপাতালে সিরিয়াল পাওয়া যায়নি, তাই রক্ত সংগ্রহের পর কোন হাসপাতালে গিয়ে ছেলের শরীরে রক্ত দেবেন, সে–ও এক বিরাট চিন্তার বিষয়।

বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০০২ সালে। আর রাজধানীর শান্তিনগরে বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতাল (২০ শয্যা) যাত্রা শুরু করে ২০০৮ সালে। ফাউন্ডেশন ও হাসপাতাল তৈরির উদ্দেশ্য জিনবাহিত বংশগত এ রোগটি নিয়ে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া।করোনাভাইরাসের বিস্তারে যেসব পরিবারে থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে, তাদের ভোগান্তি বেড়েছে বহুগুণ। ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা চালাতে গিয়ে এমনিতেই হিমশিম খেতে হয়, বর্তমানে অনেকের কাজ নেই, বেতন পাচ্ছেন না–সহ নানা সমস্যা যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংকটও তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা চিকিৎসক মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিস্তারে আমাদের কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চলছে। আমাদের হাসপাতালে মাত্র ২০টি শয্যা। আগে এক বিছানায় দুই রোগীকে একসঙ্গে রেখে রক্ত দেওয়া গেলেও এখন ভাইরাসের বিস্তারের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আগে আমরা ক্যাম্প করে রক্ত সংগ্রহ করতাম, এখন সে কার্যক্রমও বন্ধ আছে। থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমরা সবাইকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতে পারছি না। আমাদের জাকাত ফান্ড থেকে যতটুকু সম্ভব দরিদ্র বা পরিবার খরচ বহন করতে পারছে না, এমন রোগীদের সহায়তা করা হচ্ছে। আমাদের ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত একজন ১১০ জন রোগীর সব ব্যয়ভার বহন করছেন। এভাবে অনেকেই একজন, দুজনের জন্য স্পনসর করছেন। সরকারের কিছু অনুদানসহ এভাবেই আমরা রোগী ও তার পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’

আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। সরকার যদি আমাদের হাসপাতালের শয্যা অনুমোদিত ২০ থেকে ১০০টি করার অনুমতি দেয়, তাহলে হয়তো সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। সামনে ঈদ। প্রতিবছর আমরা উচ্চবিত্ত বা সামর্থ্যবানদের আহ্বান জানাই তাঁদের জাকাতের টাকা যাতে এই অসহায় রোগীদের পেছনে ব্যয় করেন। জাকাত ফান্ডে পর্যাপ্ত তহবিল থাকলে রোগীদের ভোগান্তি কিছুটা কমানো সম্ভব। কারও বিল ছয় হাজার টাকা এসেছে, রোগীর পরিবার ৫০০ টাকা দিতে পারবে, তখন জাকাত ফান্ডের টাকা দিয়ে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। ওষুধের খরচ দিয়ে বা বিভিন্নভাবে জাকাত ফান্ড থেকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।’

খায়রুল হাসানের শরীরেও বাসা বেঁধেছে থ্যালাসেমিয়া। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীতে ২৬ বছর বয়সী বোনকে নিয়ে সংগ্রাম করছেন এক ভাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ ভাই বললেন, ‘ছোট থেকেই বোনের শরীরে রক্ত দিতে হচ্ছে। প্রতি মাসে এখন তিন ব্যাগ রক্ত লাগে। রক্তটা দিলে সে মোটামুটি সুস্থ থাকে। করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর রক্ত সংগ্রহ করাটাই কঠিন হয়ে গেছে। একেক ব্যাগ রক্তের পেছনে সর্বনিম্ন খরচ দুই হাজার টাকা। খরচের চিন্তা তো আছেই, এখন তো ডোনার বা রক্ত কিনতেও পাওয়া যাচ্ছে না। বোনটা পাশের ঘরে ঘুমায়। রাতে খুট করে একটু শব্দ হলেও বোনকে দেখতে যাই। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে গিয়ে দেখব বোনের হাত–পা বাঁকা হয়ে গেছে। রক্ত সংগ্রহ করতে পারছি না, বোন বুঝতে পারে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দুই বোন আর আমাকে ছোট রেখে বাবা মারা গেছেন। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। আমি নিজেও অসুস্থ। দুই বোন আর মায়ের খরচ মেটানোর পাশাপাশি আমাদের দুই ভাই–বোনের চিকিৎসার খরচ মেটাতে যে ভোগান্তি, তা ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। মধ্যবিত্ত বলে সবার কাছে সাহায্যও চাইতে পারি না।’

চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিরোধের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে

বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটিতে যুক্ত আছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ কর্মকর্তা জানান, তিন বছর বয়সী নাতনি থ্যালাসেমিয়ায় মারা যাওয়ার পর তিনি এ ফাউন্ডেশনের কথা জানতে পারেন এবং ২০১৪ সালের দিকে ফাউন্ডেশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন।

এ কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা পাগলের মতো নাতনির জন্য রক্ত খুঁজতাম, সে যে কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, তা বলে বোঝানো যাবে না। এ অভিজ্ঞতা যাতে আর কারও না হয়। থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকা জরুরি। ফাউন্ডেশনের হাসপাতালে সেভাবে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু পরিসর তো সীমিত। মাত্র ২০টি শয্যায় রোগীদের চাহিদা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার নাতনির পেছনে মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হতো, যা যেকোনো পরিবারের জন্যই একটি বাড়তি বোঝা। আমি আমার পরিবার, ভাইবোন, আত্মীয়দের বলে ফাউন্ডেশনের জাকাত তহবিলে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করি। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদেরই এভাবে এগিয়ে আসা জরুরি।’

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি নিজে থ্যালাসেমিয়ার বাহক (পরে জানতে পেরেছি)। আমার তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে বাহক হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, মেয়ের জামাইও বাহক, যা তাদের বিয়ের আগে জানতে পারিনি। বিয়ের আগে হবু স্বামী–স্ত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। দুজনেই বাহক হলে বিয়েটা বন্ধ বা বিয়ে হলেও যাতে সন্তান না নেয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ের বিষয়েও থ্যালাসেমিয়া বিশেষজ্ঞরা নিষেধ করেন। আর যদি কেউ থ্যালাসেমিয়ার রোগী হয়েই যায়, তখন যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেই হবে।’

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের দেওয়া হিসাব বলছে, দেশে আনুমানিক ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। আর রোগীর সংখ্যা ৬০ হাজার। স্বামী ও স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের শতভাগ সম্ভাবনা থাকে থ্যালাসেমিয়া হওয়ার।

সানজিদ হোসেন। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত সানজিদের মতো অনেকেই সহায়তার জন্য তাকিয়ে আপনার দিকে। ছবি: সংগৃহীত

আপনার সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছে তারা

করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের মধ্যেও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিস্তার নেই। শরীরে রক্ত না দিলে এই রোগীদের শরীরে দেখা দিতে থাকে নানা জটিলতা। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা হামিদা বেগমের দুই ছেলেও থ্যালাসেমিয়া রোগী। বিল্লাল আর ফেরদৌসকে নিয়ে মিরপুর থেকে শান্তিনগরে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এই দুই ছেলের বাবা দিনমজুর। দুই মাস ধরে কাজ বন্ধ।

ছোট সুমাইয়ার বাবা মারা গেছেন। দিশেহারা হয়ে পড়েন সুমাইয়ার মা। থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন জাকাত তহবিল থেকে সুমাইয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এ মায়ের চিন্তা একেবারে যায় না। জাকাত তহবিলে সহায়তার পরিমাণ কমে গেলে তো তাঁর সন্তানের চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে যাবে।

থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৩ হাজার ২০৫ জন নিবন্ধিত রোগীর অধিকাংশই হতদরিদ্র বা নিঃস্ব। ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছর ফাউন্ডেশন ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা জাকাত সংগ্রহ করেছে। যার মাধ্যমে ৪২৮ জন রোগীকে সারা বছর চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশনে সাহায্য করার ঠিকানা, বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশন (জাকাত ফান্ড), হিসাব নম্বর ২০৫০১৪৫০১০০৫১৯৩১৫, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, মৌচাক শাখা, ঢাকা অথবা হিসাব নম্বর ০১১৩০৯৯৪৮০২, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, গুলশান শাখা, ঢাকা। অনলাইনে ভিসা, মাস্টারকার্ড বা আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ডের মাধ্যমে দান করতে ভিজিট করুন www.thals.org/zakat । বিকাশ নম্বর ০১৭২৯২৮৪২৫৭ 'পেমেন্ট' অপশন ব্যবহার করেও টাকা পাঠাতে পারেন। ফাউন্ডেশনের জাকাত সম্পর্কে জানতে ভিজিট করা যাবে: https://www.thals.org/zakat-for-life এ ঠিকানায়।

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থ্যালাসিমিয়া ফাউন্ডেশনের জাকাত তহবিলের উদ্যোগকে সহায়তা করছে প্রথম আলো।