সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি

শহরের চেয়ে গ্রামে সরকারি সহায়তা অনেক বেশি

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক ফারাকের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, শহরের তুলনায় গ্রামের সাড়ে তিন গুণ বেশি মানুষ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে।

রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকার বারইখালী বস্তির বাসিন্দা মো. আবুল কাশেমের বড় মেয়ে ইয়াসমিন (২৫) মানসিক প্রতিবন্ধী। কয়েক বছর আগে মেয়ের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এরপর আর চেষ্টা করেননি।

আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগর দারিদ্র্য বস্তিবাসী উন্নয়ন সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক আমি। কিন্তু বস্তি থেকে যিনি ভাতার জন্য তালিকা তৈরি করছিলেন, তিনি আমার কাছে টাকা চান। টাকা দিয়ে আমি কার্ড করাব না।’ টাকা ছাড়া কার্ড পাওয়ার সুযোগ থাকলে তাঁর মেয়ের জন্য একটি কার্ড করে দিতে এই প্রতিবেদককে অনুরোধ জানান তিনি। তাঁর মতে, তাঁদের বস্তির বাসিন্দাদের মধ্যে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় খুব কম মানুষই আছেন, কিন্তু অনেকেরই ভাতা প্রয়োজন।

জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) মধ্যবর্তী পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক ফারাকের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, শহরের তুলনায় গ্রামের সাড়ে তিন গুণ বেশি মানুষ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে। গত বছরের ২০ জুলাই মধ্যবর্তী পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ (জিইডি)।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামের বাসিন্দাদের ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ অন্তত একটি সামাজিক কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। বর্তমানে গ্রামের দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, আর শহরে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। শহরে এই শ্রেণির মাত্র ১০ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আছে। বয়স্ক ভাতার মাত্র ৬ শতাংশ পায় শহরের দরিদ্ররা, আর বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতার মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ পায় তারা।

কল্যাণপুর বস্তির বাসিন্দা আবদুল মান্নান (৬৬) চার মাস আগে বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করে এখনো অপেক্ষায় আছেন। তাঁর স্ত্রী নুরুন্নাহার (৫৫) জানালেন, বস্তির একটি ঘরে তাঁরা থাকেন। ছোট ছেলে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তিনি কিছু টাকা দেন; তা দিয়েই সংসার চলে। নগর বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থা এবং কমিউনিটি বেইজড অর্গানাইজেশন, কল্যাণপুরের সাধারণ সম্পাদক মো. হান্নান আকন্দ জানান, কল্যাণপুর বস্তিতে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ বাস করে।

মহানগরের দরিদ্র নারীদের জন্য বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচিই নেই। এ কারণে কড়াইল বস্তির ঝর্ণা বেগম (৫৯) এবং মনোয়ারা বেগম (৫০) ২০ ও ১৪ বছর ধরে বিধবা হলেও এ ভাতা পান না।

বস্তিতে চাহিদার তুলনায় কার্ড কম

২০১৭ সালের হিসাব অনুসারে, কড়াইল বস্তিতে প্রায় ১ লাখ ৪৯ হাজার মানুষের বাস। তাদের মধ্যে ৫০৯ জন প্রতিবন্ধী এবং তৃতীয় লিঙ্গের আছেন ৬৬ জন। বয়স্কদের আলাদা হিসাব নেই। এই বয়স্কদের ২০ শতাংশ ভাতা পান বলে মনে করছেন বেসরকারি সংগঠন কড়াইল কমিউনিটি বেইজড অর্গানাইজেশনের সভাপতি মোসাম্মৎ সেলিনা আক্তার।

কড়াইল বস্তিতে বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকাভুক্তির কাজ করছেন বস্তির নেতৃস্থানীয় এবং মহিলা শ্রমিক লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি নুরুন্নাহার। তিনি বলেন, বস্তির ৬০০-এর মতো বাসিন্দা এ দুটি ভাতা পাচ্ছেন। গত মাসে আরও ৫০০-এর মতো নতুন আবেদন যাচাই-বাছাই করছেন তালিকাভুক্তির জন্য। এ ছাড়া করোনার কারণে ভাতাপ্রাপ্ত কেউ কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন। বছরে তিন কিস্তিতে ভাতা পান তালিকাভুক্তরা। এক কিস্তি যাঁরা ভাতা তোলেননি, তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। তাঁরা আরও দুই কিস্তি ভাতা না তুললে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।

কল্যাণপুর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য নতুন ১৫০টি আবেদন পেয়েছি গত চার মাসে। কিন্তু আমার ওয়ার্ডে চাহিদা অনুযায়ী ভাতার কার্ড বরাদ্দ নেই। আমি বারবারই সমাজসেবা অধিদপ্তরে কার্ডসংখ্যা বাড়ানোর তাগাদা দিচ্ছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না।’

ভাতাভুক্ত হয়েও তথ্যের গরমিলে বাদ পড়ছেন কেউ কেউ

কল্যাণপুর বস্তির সোনা মিয়া ২০০৭ সালে বয়স্ক ভাতার আওতাভুক্ত হন। বয়স্ক ভাতার কার্ডে তাঁর বয়স ৮১ বছর। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে ৭০ বছর লেখা। বয়সের জটিলতায় ৯ মাস ধরে তিনি ভাতা পান না। তাঁর ছেলে আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজসেবা অফিসে তিনবার কাগজপত্র জমা দিয়েছি। এখনো সমাধান হয়নি।’ জানা গেল, একই রকম সমস্যায় আছেন ওই বস্তির মনোয়ারা বেগম ও সফুরা বেগম।

এ ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শাখা) ফরিদ আহমেদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, আগে জন্মনিবন্ধন দিয়ে বয়স্ক ভাতার কার্ড হতো। এখন জাতীয় পরিচয়পত্র দেখা হয়। অনেকের এ দুটোতে বয়সের পার্থক্য হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এসব ঠিক করা হবে।

‘গ্রামে গেলে উল্টো শুনি, শহরের লোকজনই সব ভাতা পায়। আসলে এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয়। শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের মানুষের কাজের সুযোগ বেশি, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।’
মো. আশরাফ আলী খান, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী

শহরের দরিদ্রদের জন্য পদ্ধতি পুনর্গঠনের তাগিদ

নগর দরিদ্রদের জন্য বড় কয়েকটি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম (ওএমএস), বুকের দুধ পান করানো শহরের নিম্ন আয়ের মায়েদের ভাতা, নগরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসহায়তা, নগরের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নগরভিত্তিক প্রান্তিক নারী উন্নয়ন এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের কর্মজীবী মায়েদের সন্তানের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র। এর মধ্যে ওএমএস ও বুকের দুধ পান করানো মায়েদের ভাতা কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রয়েছে। শহরের দরিদ্রদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে এলজিইডি মন্ত্রণালয় একটি গবেষণা প্রতিবেদন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে। সেটা নিয়ে বেশ কয়েকটি কর্মশালাও হয়েছে। এরপর আর অগ্রগতি হয়নি।

এনএসএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রামের উদ্দেশে করার প্রচলন আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরে বাসিন্দার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দারিদ্র্য, বঞ্চনা। শহরের দারিদ্র্যের হার কমানোর উদ্যোগ কম দেখা যাচ্ছে। আবার গ্রাম থেকে দরিদ্র পরিবারগুলো শহরমুখী হচ্ছে। ফলে শহরের দারিদ্র্য হার এক জায়গায় আটকে আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের এই বৈষম্যের কারণে নগরের দারিদ্র্য ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।

তবে এই প্রতিবেদনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘গ্রামে গেলে উল্টো শুনি, শহরের লোকজনই সব ভাতা পায়। আসলে এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয়। শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের মানুষের কাজের সুযোগ বেশি, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।’

এনএসএসএস অবশ্য শহর ও গ্রামের দরিদ্রদের জন্য সমানভাবে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অবসর ভাতা, প্রতিবন্ধিতা এবং শিশু সুযোগ-সুবিধাবিষয়ক কিছু কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এনএসএসএসের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ৪ কোটি মানুষ দরিদ্র। দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৩ কোটি মানুষ। এটা মোট জনসংখ্যার ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ।

সমাজসেবা অধিদপ্তর ও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের ১৪৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবার এসব কর্মসূচির আওতায় আছে। ভাতার ৩৫ শতাংশের বেশি বরাদ্দ রয়েছে সরকারি চাকরিজীবী ও তাঁদের পরিবারের জন্য অবসর ভাতা হিসেবে। উপকারভোগীর দিক দিয়ে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি ও ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচি সবচেয়ে এগিয়ে—প্রায় ১৭ শতাংশ।

আগে দারিদ্র্য বিমোচনের হারে গ্রামের চেয়ে শহর এগিয়ে ছিল। আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে নতুন প্রবণতা দেখা যায়, শহরে দারিদ্র্য বাড়া শুরু হয়েছে। কারণ, গ্রামের দরিদ্ররা শহরে চলে আসছে
কে এ এম মোর্শেদ , বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক

গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত নগর আর্থসামাজিক আস্থা নিরূপণ জরিপে বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের খানাগুলো বাদ পড়ে যাচ্ছে। এখানে বয়স্ক ভাতার আওতায় আছে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি পায় এমন খানা পাওয়া গেছে মাত্র ৩ শতাংশ। কর্মসূচিগুলো নিম্ন আয়ের খানাগুলোর প্রয়োজনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে দারিদ্র্য বিমোচনের হারে গ্রামের চেয়ে শহর এগিয়ে ছিল। আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে নতুন প্রবণতা দেখা যায়, শহরে দারিদ্র্য বাড়া শুরু হয়েছে। কারণ, গ্রামের দরিদ্ররা শহরে চলে আসছে।

কে এম মোর্শেদের মতে, গ্রামের তুলনায় শহরে আয় যেমন বেশি, ব্যয়ও বেশি। তাই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শহরেও সমানভাবে প্রয়োজন। শহরের দরিদ্রদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বঞ্চনার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। তবে এসব কর্মসূচি গ্রামের চেয়ে ভিন্ন নকশায়, শহরের উপযোগী করে বাস্তবায়ন করতে হবে। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত কম খরচে স্বাস্থ্যবিমার ওপর, একজন যেন মাসে ৫০ টাকা খরচ করে ভালো সেবা পেতে পারেন। গ্রামের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা শহরে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শহরের দরিদ্রদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।