আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে পদ্মার পানি। তাতে আগে থেকেই বিপাকে থাকা মানুষের বিপদও বেড়েছে। জেলার সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উপার্জনহীন মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
গতকাল বুধবার পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে। নড়িয়ার ঈশ্বরকাঠি, চোকদারকান্দি, মুলপারা, জাজিরার কলমিরচর, খালাসিকান্দি গ্রামে গিয়ে জানা গেল, প্রায় দেড় মাস ধরে ওই এলাকার মানুষ পানিবন্দী। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ আর আয়ের উপায় খুঁজে পায়নি। উপার্জন না থাকায় প্রায় সব পরিবারেই খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এলাকার নলকূপ ও টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানি এবং স্বাস্থ্যসংকট দেখা দিয়েছে।
নড়িয়ার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জেসমিন আক্তারদের কৃষিজমি দুই বছর আগে পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে স্বামী নুরুল ইসলাম কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। জেসমিন গবাদিপশু লালনপালন করেন। তাঁদের আয়ে সংসার চলে। দেড় মাস ধরে বন্যার পানিতে এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় কাজ বন্ধ। তাঁদের ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। নিজেদের ও গবাদিপশুর খাদ্য সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারটিকে।
জেসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী অবস্থার মধ্যে আছি, তা বইল্লা বুঝাইতে পারুম না। স্বামীর কাম নাই, ইনকাম নাই। ঘরে খাওন নাই। দিনে একবার রান্না করি, বাচ্চারা দুইবার খায়। আর আমরা একবারই খাই। গরুর খাবারও নাই। জীবনে এত কষ্ট কহনো করি নাই।’
জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মধ্য জুন থেকে পদ্মা নদীতে পানি বাড়তে থাকে। তখন নদী–তীরবর্তী গ্রামগুলো তলিয়ে যায়। গত দেড় মাসে পানি বাড়তেই থাকে। বর্তমানে জেলার নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের ৪০০ গ্রাম বন্যার পানিতে ডুবে আছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৯৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে দুর্গত মানুষের জন্য। জেলা প্রশাসন ৬৪ হাজার ২০১ পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল এবং চার হাজার পরিবারকে শুকনা খাবার দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
জাজিরার কলমিরচরের বাসিন্দা তুহিন চোকদারের বসতবাড়ি, আবাদি জমি দুই বছর আগে পদ্মায় বিলীন হয়েছে। নিঃস্ব তুহিন তখন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলায় কাপড় বিক্রি শুরু করেন। করোনার কারণে তা–ও বন্ধ। বন্যায় বাড়িঘর ও গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে বসে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে সাত সদস্যের সংসার নিয়ে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। তুহিন চোকদার বলেন, পাঁচ মাস ধরে কোনো কাজ নেই। গরিব মানুষ কি কাজ না করে বাঁচতে পারে? ১০ কেজি চাল দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে, তা দিয়ে চার দিন চলেছেন। এখন অর্ধাহারে–অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।
নড়িয়ার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দী। সরকারি ত্রাণ হিসেবে ৮০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ও ৩০০ পরিবারকে শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। পানিবন্দীদের অধিকাংশই নদীভাঙনকবলিত। অসহায় ও নিঃস্ব ওই সব মানুষের প্রত্যেকের খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম চৌকিদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি যে ত্রাণ পাওয়া গেছে, তা খুবই অপ্রতুল। এলাকায় যেতে পারছি না, মানুষের কষ্ট দেখতে ভালো লাগছে না। এমনিতেই নদীভাঙনে মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব। তার ওপর বন্যায় তাঁদের জীবন একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।’ স্থানীয় সাংসদ ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হকের উদ্যোগে কিছু ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
জানতে চাইলে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেওয়া চাল দুর্গতদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে এক দফা করে দেওয়া হয়েছে। ইউএনওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় দফার চাহিদা দেওয়ার জন্য। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে দ্বিতীয় দফা খাদ্যসহায়তা দেওয়ারও প্রস্তুতি রয়েছে।