>* খুলনা নগরের সীমানা ঘেঁষে মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
* বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র পাঁচজন শিক্ষক আছেন।
* শ্রেণিকক্ষ-সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে বারান্দায় বসে।
* ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জেলার সেরা স্কুলের মর্যাদা লাভ করে।
* কয়েক বছর ধরে পাসের হার শতভাগ।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি ৪০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকার কথা। খুলনা নগরের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র পাঁচজন শিক্ষক আছেন। ওই বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসম্মত কোনো শৌচাগার, এমনকি খেলার মাঠও নেই। আর শ্রেণিকক্ষ-সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে বারান্দায় বসে।
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জেলার সেরা স্কুলের মর্যাদা লাভ করে। জেলার সব উপজেলার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাসের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্কুলটি। কয়েক বছর ধরে পাসের হার শতভাগ। গতবার পাঁচটি ট্যালেন্টপুলসহ সাতজন বৃত্তি পেয়েছিল। শিক্ষকেরা আশা করছেন, এবার আরও বেশি বৃত্তি পাবে।
খুলনা জেলার ১ হাজার ১৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে এই বিদ্যালয়ে। কিন্তু অবস্থা এমনই যে বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে এই বিদ্যালয়ের শিশুরা। মহুয়া আক্তার নামের এক অভিভাবক বললেন, এই স্কুলে সব গরিব লোকের বাচ্চারা পড়ে, এ জন্য কারও নজর নেই। না হলে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী হয়েও বেশি বঞ্চিত কেন?
নগরের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত বিদ্যালয়টি বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, ছোট জায়গার মধ্যে অবস্থিত বিদ্যালয়টির ভেতরে অন্য এক জগৎ। খুলনার অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৬৫ জন শিক্ষার্থী নেই। কিন্তু এখানে প্রথম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত কক্ষে ক্লাস করছে ১৬৫ শিশু। ৩০ ফুট লম্বা আধপাকা কক্ষে গাদাগাদি করে বসছে সবাই। চার ফুটের একটি বেঞ্চে পাঁচজন করেও বসেছে। প্রথম শ্রেণির জন্য কোনো শিক্ষক নেই। শিশুদের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং লেখাপড়া চালিয়ে নিতে এলাকার এক নারীকে ক্লাসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৬৫ শিশুকে একা পড়াতে গিয়ে তাঁর নাভিশ্বাস ওঠার দশা।
দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাসও হচ্ছে আধপাকা আরেকটি কক্ষে। সেখানে উপস্থিত ছিল ১৪৮ শিক্ষার্থী। একইভাবে গাদাগাদি করে সবাই লেখাপড়া করছে। বিদ্যালয়টির একমাত্র ভবনের একটিতে অফিস কক্ষ, অন্যটিতে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস হচ্ছে।
পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছিলেন স্কুলের নিয়মিত শিক্ষক শামীমা সুলতানা। তিনি বলেন, ৪০ জনের জন্য নির্ধারিত কক্ষে ১৮৯ জন শিশু বসে আছে। তাদের শান্তভাবে বসিয়ে ক্লাস করানো যুদ্ধজয়ের সমান। বেশি জোরে কথা বলায় স্কুলের সব শিক্ষকেরই গলা ভাঙা।
শিক্ষকেরা জানান, ছাত্র অনুপাতে স্কুলে শিক্ষক প্রয়োজন ২৮ জন। কিন্তু আছে মাত্র পাঁচজন। এ জন্য একেকজন শিক্ষককে দুটি করে ক্লাস নিতে হয়। কিন্তু এক ক্লাসে এত শিক্ষার্থী, প্রথম ক্লাসে বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় ক্লাসে বাচ্চাদের আর সামলানো যায় না। স্কুলে অনেক সমস্যা থাকলেও শিক্ষক-সংকটের সমস্যাটাই এখন প্রকট।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র খন্দকার আবু নাঈম বলে, তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষক নেই। এক ম্যাডাম দুই থেকে তিনটি ক্লাস নেন। খেলার মাঠ না থাকায় তারা বিদ্যালয়ে এসে খেলতে পারে না।
স্কুল ঘুরে দেখা গেল, খানিক দূরে ময়ূর নদের পাড়ে পলিথিন দিয়ে ঘিরে শৌচাগারের রূপ দেওয়া হয়েছে। সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বেশি থাকায় প্রেষণে সাতজন শিক্ষক দেওয়া হয়েছিল। ১১ জন শিক্ষক দিয়ে কোনোমতে ক্লাসগুলো চালানো হতো। কিন্তু গত ১৪ নভেম্বর জেলা শিক্ষক সমন্বয় কমিটির সভায় বাকি শিক্ষকদের প্রেষণ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে পাঁচজন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালাতে হচ্ছে। আর বাচ্চাদের সামলাতে এলাকার কয়েকজনকে দিয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এত সংকটেও ভালো ফলের কারণ জানাতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়ানো হয়।
কিছুদিন আগে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন খুলনা জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান। তিনি বলেন, এত শিক্ষার্থী যে বিদ্যালয়ে পড়ে, সেই বিদ্যালয়ে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই। সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের কাছে ইতিমধ্যে চিঠি লেখা হয়েছে।