২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা–কর্মীসহ ২২ জন নিহত হন। আজ এ ভয়াবহ হামলার ১৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
‘নিজের কোনো ঠিকানা নেই। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এখন আমাকে চেনে না। করোনার মধ্যে গত বছর চাকরিটাও চলে গেছে। ধারদেনা করে চরম অভাবে দিন কাটছে। সরকারের কোনো সহায়তা ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকব! লিখে দেন, জজ মিয়া মরে গেছে।’
করোনাকালে কেমন আছেন জজ মিয়া, তা জানতে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। প্রশ্ন শুনে বর্তমান অবস্থা নিয়ে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান মো. জালাল; সারা দেশে যিনি জজ মিয়া নামেই পরিচিত। চাপের মুখে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি। বিনা অপরাধে পাঁচ বছর কারাভোগ করতে হয়েছিল তাঁকে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলের পর তিনিই তুলে ধরেন প্রকৃত সত্য।
জজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে থাকতেই আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে মোহাম্মদ নাসিমের সুপারিশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়িচালকের চাকরি পান। কয়েক বছর এ চাকরি করেই সংসার চলেছে। গত বছরের জুনে নাসিমের মৃত্যুর পর ওই চাকরিটা চলে গেছে। সংসার চালাতে ইতিমধ্যে তিন লাখ টাকা দেনা করেছেন।
কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে রাজধানীর শনির আখড়ায় বাস করছেন জজ মিয়া।
কারাগার থেকে মুক্তির পর আওয়ামী লীগের এক নেতার মাধ্যমে একবার প্রধানমন্ত্রীর দেখা পান জজ মিয়া। পুনর্বাসনের জন্য একটি আবেদন জমা দিতে ওই নেতাকে পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওই নেতা আর কোনো ব্যবস্থা নেননি। এরপর এক যুগ ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছেন জজ মিয়া।
১৬ আগস্ট আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান জজ মিয়া। সহায়তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি চিঠি জমা দিয়ে এসেছেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিএনপি, জামায়াত কর্তৃক সাজানো নাটকের বানানো নায়ক কালের সাক্ষী আমি মো. জালাল (জজ মিয়া) এখন সহায়-সম্বলহীন জীবন-যাপন করছি।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠিতে জজ মিয়া বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার আসামি করায় মামলা চালিয়ে এখন আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় রয়েছি। করোনা মহামারিতে আমার মা মারা যায়। বর্তমানে আমি কর্মহীন। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি কাজের জন্য আবেদন করছি। যাতে পরিবার নিয়ে কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারি।’
জজ মিয়া বলেন, ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সবাই কোনো না কোনো সহায়তা পেয়েছেন। আমি হামলায় আহত হইনি। কিন্তু ওই ঘটনায় আমিও বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। অথচ সরকার থেকে পাইনি কোনো সহায়তা। আমার প্রতি এত অবিচার কেন!’
প্রসঙ্গত, শুরু থেকেই গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে শৈবাল সাহা পার্থ ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমানকে ফাঁসাতে না পেরে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় জজ মিয়া নামের এক যুবককে। জজ মিয়াকে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে সিআইডি। ২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।
এই জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ২৯ জুন প্রথম আলোয় দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। একটির শিরোনাম ছিল ‘এই গল্পের গাঁথুনি দুর্বল/ স্বীকারোক্তিতে সাত অসংগতি’। অপরটির শিরোনাম ‘সেই জজ মিয়া তারকা সন্ত্রাসী’। সঙ্গে ছাপানো হয়েছিল শিশির ভট্টাচার্য্যের সেই বিখ্যাত কার্টুন (আষাঢ় মাস...জমেছে আষাঢ়ে গল্পের আসর)। তবে সিআইডি সাজানো ছকেই তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার ছোট বোন খোরশেদা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘জজ মিয়ার পরিবারকে টাকা দেয় সিআইডি’ শিরোনামে শীর্ষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর জোট সরকার আর ‘জজ মিয়া গল্প’ নিয়ে এগোতে পারেনি।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অব্যাহতি দেওয়া হয় জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়া জজ মিয়া, পার্থসহ ২০ জনকে।