ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারা। উইন্ডিজ ক্রিকেটের সোনালি সময়ের শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা লারা অবসর শেষে নিজেকে কিংবদন্তি ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাঁর। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে পরপর দুই বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের সঙ্গে পরাজয়ের পর আর কখনো ফাইনালই খেলতে পারেননি ক্যারিবিয়ানরা। তবে এরপরের সময়েই দলে আগমন ঘটেছে ব্রায়ান লারা ও ক্রিস গেইলের মতো বিস্ময়কর সফলতা অর্জনকারী দুই ক্রিকেটারের। হালের টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগে উইন্ডিজ দুইবার বিশ্বসেরার মুকুট অর্জন করলেও দলীয় বড় সফলতা অর্জনের হিসেবে লারাকে থামতে হয়েছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয়ের স্মৃতি নিয়েই। আর ব্যক্তিগত অর্জনে হয়েছেন ক্রিকেট আকাশের উজ্জ্বল তারা, যে তারায় ক্রিকেট আকাশ আলোকিত হয়ে থাকবে বাইশ গজে যত দিন ব্যাটে–বলের লড়াই চলবে।
বয়সভিত্তিক দলগুলোতে নিজের জাত চিনিয়ে ১৯৮৭–৮৮ সেশনে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় ব্রায়ান চার্লস লারার। উইন্ডিজ দলে সুযোগ পাওয়ার পর বাবার মৃত্যুতে নাম প্রত্যাহার করে নিলেও পরবর্তী সময়ে পুনরায় দলে জায়গা করে নিয়ে ১৯৯০ সালে অভিষেক হয় উইন্ডিজ জাতীয় দলে। ৯ নভেম্বর করাচিতে পাকিস্তানের সঙ্গে অভিষেক ওয়ানডেতে ২০ বলে থেমেছিলেন মাত্র ১১ রানে। ৬ ডিসেম্বরে লাহোরে পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট অভিষেকে প্রথম ইনিংসে ৪৪ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ রান দিয়ে টেস্ট যাত্রা শুরু।
অভিষেকে আলো ছড়াতে না পারলেও বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই লম্বা ইনিংস খেলতে পারদর্শী লারা নিজেকে মেলে ধরতে তেমন সময় নেননি। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ৬৪ রানের ইনিংস খেলার পর ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যক্তিগত তৃতীয় টেস্টে ৫৮ ও চতুর্থ টেস্টে ৫২ রানের ইনিংস খেলার পর ২ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে সিডনিতে শুরু হওয়া টেস্টে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির ইনিংসকেই পরিণত করেছেন ২৭৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসে। উইকেটে টিকে থেকে রান করার মন্ত্রই যেন শিখিয়েছিলেন ৩৭২ বলে ৩৮ চারে খেলা ২৭৭ রানের ইনিংসের মাধ্যমে। ড্রয়ের ম্যাচটিতে ম্যাচসেরাও হন তিনি।
উইকেটে থিতু হয়ে গেলে রানের নেশায় মত্ত হয়ে যাওয়া লারা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মাত্র সাত বছরের মাথায় কাউন্টি ক্রিকেটে বিস্ময়কর রেকর্ডের জন্ম দিয়েছেন, যা আজও রেকর্ড বুকে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
২ জুন ১৯৯৪ সালে বার্মিংহামের এজবাস্টনে ডারহাম বনাম ওয়ারউইকশায়ারের ম্যাচে ওয়ার্কউইকশায়ারের হয়ে খেলতে নামেন লারা। চার দিনের ম্যাচটিতে টসে জিতে ব্যাট করতে নামে ডারহাম। জন মরিসের ২০৪ রানের সুবাদে ৮ উইকেট হারিয়ে দ্বিতীয় দিনে ৫৫৬ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ডারহাম। দ্বিতীয় দিনেই ব্যাট করতে নামে ওয়ারউইকশায়ার। দ্বিতীয় দিনেই ২ উইকেট হারিয়ে ২১০ রান সংগ্রহ করে ওয়ারউইকশায়ার। ১১১ রান করে অপরাজিত থাকেন লারা।
তৃতীয় দিনে খেলা হয়নি। তারপরের দিনও রেস্ট ডে হিসেবে খেলা হয়নি। তারপরের দিন আজকের দিনে তথা ৬ জুন মাঠে গড়ায় চতুর্থ ও শেষ দিনের খেলা। চতুর্থ দিনে প্রথম ইনিংসের খেলা গড়ানোয় ম্যাচে ফলাফল আসবে না তা নিশ্চিতই ছিল, আর তাই হয়তো নির্ভার হয়ে ব্যাট হাতে ঝড় তোলেছিলেন লারা। একে ট্রেভর পেন্নই, পল স্মিথ ও কিথ পিপারকে নিয়ে জুটি বেঁধে খেলেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী ৫০১ রানের ইনিংস। মাত্র ৪২৭ বলে ১০টি ৬ ও ৬২ চারে ৫০১ রানে অপরাজিত থাকেন লারা। কিথ পিপার ১৫১ বলে ১১৬ রান করে অপরাজিত থাকেন। ৪ উইকেট হারিয়ে ৮১০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ওয়ারউইকশায়ার। ড্রয়ে পরিণত হয় ম্যাচটি।
লারা ৫০১ রানের ইনিংস খেলার পথে ভেঙেছেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান হানিফ মোহাম্মদের ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানি ঘরোয়া লিগ কায়েদ–এ–আজম ট্রফিতে করাচির হয়ে খেলা ৪৯৯ রানের রেকর্ড ইনিংস। স্কোরারের ভুলে নিজের সংগ্রহের দিকে খেয়াল রাখতে না পারা হানিফ মোহাম্মদ প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০০ রানের কাছাকাছি গিয়েও রান আউটের শিকার হয়ে ফিরেছেন। তিনি ভেবেছিলেন ৪৯৭ রানেই তিনি আউট হয়েছেন, পরে দেখলেন ৪৯৭ নয়, তিনি ৪৯৯ রানে আউট হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে হানিফ মোহাম্মদ জানান, তিনি নিজের স্কোর তখন ৪৯৮ জানলে কখনোই ২ রান নিতে গিয়ে ওভাবে আউট হতেন না। হানিফ মোহাম্মদ সেদিন ভেঙেছিলেন ১৯৩০ সালে স্যার ডন ব্র্যাডমানের গড়া ৪৫২ রানের রেকর্ড ইনিংস। আর দীর্ঘ ৩৫ বছর পর হানিফ মোহাম্মদের রেকর্ড ইনিংস ভেঙে লারা খেললেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০০ ছাড়ানো ইনিংস।
১৯৯৪ সালে গড়া লারার রেকর্ডটি এখনো সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হয়ে আছে। পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে তথা দীর্ঘ ১০ বছর পর টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৪০০ রানের ইনিংস খেলেছেন লারা। ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা অপরাজিত ৪০০ রানের ইনিংসটিও টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হয়ে আছে।
মজার বিষয় হলো, লারা ৫০১ ও ৪০০ রানের ইনিংসের পাশাপাশি ১৯৯৪ সালে ৫০১ রানের ইনিংস খেলার আগেই ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলেছিলেন ৩৭৫ রানের ইনিংস, যা ছিল টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে ৩৭৫ রান করার পর ৬ জুন খেলেছিলেন কাউন্টিতে ৫০১ রানের ইনিংস। দীর্ঘ ১০ বছর পর ৪০০ রানের ইনিংস খেলে নিজেই ভেঙেছিলেন নিজের গড়া ৩৭৫ রানের রেকর্ড। ৫০১ রানের ইনিংসটি ১৯৯৪ সাল থেকে এবং ৪০০ রানের ইনিংসটি ২০০৪ সাল থেকেই সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হিসেবে বিদ্যমান আছে। ২০০৪ সালের পর ম্যাথু হেইডেন ৩৮০ ও মাহেলা জয়াবর্ধনে ৩৭৪ রানের ইনিংস খেলার পথে লারার ৪০০ রানের ইনিংসটিকে হুমকিতে ফেলে দিলেও লারার গড়া ৫০১ রানের ইনিংসটিতে যেন ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে, যা কোনোদিন ভাঙা সম্ভব না–ও হতে পারে।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের একাধিক রেকর্ড গড়া ব্রায়ান লারা কিন্তু শুধু টেস্ট ব্যাটসম্যান ছিলেন না। ব্যাট হাতে ঝড় তোলার জন্য লারা ছিলেন দুর্দান্ত, অসাধারণ। ৫০১ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন মাত্র ৪২৭ বলে।
লম্বা ইনিংসকে ডালভাত বানিয়ে ফেলা লারা ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরিচয় দিয়ে লড়াই করার পাশাপাশি এক দিনের ক্রিকেটে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতেও বেশ পারদর্শী ছিলেন। দলের হয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা না হলেও ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালানো একাধিক ইনিংস আছে জাতীয় দলের হয়েই। ওয়ানডে ক্রিকেটে মাত্র ৪৫ বলে সেঞ্চুরি আছে লারার। যেখানে যেমন প্রয়োজন, সেখানে সেভাবে ব্যাট করতে পারদর্শী লারা হয়েছেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের বরপুত্র।
উইন্ডিজ ক্রিকেটের দাপট শেষ হওয়ার দিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা লারা ক্যারিয়ারজুড়ে দলের হয়ে লড়াই করেছেন সামনে থেকে। লারার সময়ে আরও বহু তারকা ক্রিকেটার থাকলেও সম্মিলিত পারফর্মের অভাবে একাই দলের হাল ধরেছেন দেড় যুগের ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার।
দেড় যুগের বর্ণিল ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সুপার এইটে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে। ব্রিজটাউনে গেইল-স্যামুয়েল-স্মিথের দুর্দান্ত ইনিংসের সুবাদে উইন্ডিজের গড়া ৩০০ রানের ইনিংসের পর ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতেছে মাত্র ১ রানে। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে ১৭ বলে ১৮ রান করা লারা অধিনায়কত্ব ও ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন ১ রানের পরাজয়ের আক্ষেপ নিয়েই। তবে পুরো ক্যারিয়ারে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো লারা থেমেছিলেন সফল ক্যারিয়ার রেখেই।
* শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)