লাখো ভক্তের পুণ্যস্নানে মুখরিত কুয়াকাটা সৈকত

সৈকতে পুণ্যার্থীদের প্রার্থনা। কুয়াকাটা, পটুয়াখালী, ৪ নভেম্বর। ছবি: সাইয়ান
সৈকতে পুণ্যার্থীদের প্রার্থনা। কুয়াকাটা, পটুয়াখালী, ৪ নভেম্বর। ছবি: সাইয়ান

হেমন্তের মিঠা হাওয়ায় সাগরটা তুলনামূলক শান্ত। ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে কিনারায়। পূর্ণিমার চাঁদের আলো তখনো মিলিয়ে যায়নি। অন্ধকার দূর হয় হয় অবস্থা। ঠিক এ সময়ে মধ্যে নারীদের উলুধ্বনিতে প্রায় তিন কিলোমিটারের দীর্ঘ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত সরগরম হয়ে উঠল। যে যাঁর মতো এসে পুণ্যস্নানের জন্য নামতে লাগলেন সাগরে। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ রাস ভক্তদের আনাগোনা। এ সময়টায় সবার ব্যস্ততা পুজোর জন্য। নিশি-ভোরের ওই লগ্নে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সাগরকন্যা কুয়াকাটা হয়ে উঠেছিল মুখরিত।
শুক্রবার রাতভর এসব হিন্দু পুণ্যার্থী কুয়াকাটার ‘রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও তীর্থযাত্রী সেবাশ্রম’ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় রীতিতে অংশ নেন। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, সারা বছরের পঙ্কিলতা দূর হয়ে সামনের জীবন হবে সুখের, সংসারে-কর্মে আসবে সাফল্য। তাই পুরো রাত জেগে তাঁরা সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে রাসভক্ত পুণ্যার্থীরা পুণ্যস্নানের ক্ষণটির জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন। প্রচ্ছন্ন কুয়াশা আর হালকা ঠান্ডায় আজ শনিবার ভোরের ওই মুহূর্ত সব শ্রেণির মানুষকে যেন আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। শুধু নিজে নয়, স্বামী-সন্তানকেও ধর্মীয়ভাবে সিদ্ধ করতে বাহুতে জড়িয়ে হিন্দু নর-নারীরা অনেকে নেমে পড়েছেন স্নানে। এ রকমই একজন বাগেরহাটের সুস্মিতা বড়াল। তিনি বলেন, ‘নানা রকম সমস্যার মধ্যেই এ বছরটা পার করেছি। সামনের দিনগুলো যাতে ভালো কাটে, সে মনোবাসনা নিয়ে পুণ্যস্নান করতে চলে এসেছি। ভালোভাবে ধর্মীয় আচার পালন করতে পাড়ায় নিজের কাছে ভালো লাগছে।’
সত্য রঞ্জন দাস নামের একজন ভক্ত সাগরের পানিতে নেমে মনে মনে কী যেন জপতে লাগলেন। খানিক পরে দুই হাতের কোষে সাগর থেকে পানি নিয়ে স্ত্রী, ছেলের মাথায়-গায়ে ঢেলে দিলেন। এভাবে ভক্তকুলের নানা রকমের নিয়ম-রীতি পালন করতে দেখা গেল। কেউ নিজের জন্য, আবার কেউ স্বর্গবাসী বাবার জন্য মানত করে সৈকতের বালুচরে বসে মাথা ন্যাড়া করেন। বিমল সিকদার নামের এক ভক্ত বলেন, ‘বাবা মারা গেছেন কয়েক মাস হলো। তাঁর নামে মানত করেছিলাম। পূর্ণিমার তিথিতে রাসপূজার সময় মাথা ন্যাড়া করে সে মানত রক্ষা করলাম।’
পটুয়াখালীর তমালিকা দেবনাথ নামের এক পুণ্যার্থী কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুণ্যার্থীদের স্নানের পর সৈকতে কাপড় পরিবর্তন করার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা নিজেরাই সৈকতের পাড়ে কাপড় ঘেরাও দিয়ে স্নানের কাপড় পরিবর্তন করেছি। স্থানীয় প্রশাসনের এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল করা উচিত ছিল।’
পূর্ণিমার এই তিথিতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাস উৎসব উপলক্ষে দেশ-বিদেশের ভক্তদের সমাগমে সমুদ্রের রানি কুয়াকাটা ছিল মুখরিত। এর আগে শুক্রবার রাত আটটায় পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. মাছুমুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাসের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মিনিস্টার এস বি এস টোমার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নিম চন্দ্র ভৌমিক, কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব তালুকদার, কলাপাড়া পৌর সভার মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার প্রমুখ।
শত বছরের ঐতিহ্য এই রাস মেলা এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। অন্য ধর্মের নারী-পুরুষরাও এ রাস মেলা দেখতে কুয়াকাটায় এসেছিলেন। সব শ্রেণির মানুষের উপস্থিতির কারণে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। রাস মেলাকে কেন্দ্র করে কুয়াকাটা সৈকত ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পুজোর সামগ্রী, ফিতা-চুড়ি, শামুক-ঝিনুকসহ নানা ধরনের খেলনার দোকান বসেছিল। তা ছাড়া খাবারের রেস্তোরাঁগুলোতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। প্রচুর বেচাকেনাও হয়েছে। মিলন বেপারি নামের এক দোকানদার বলেন, গতবারের চেয়ে এবার তাঁর বিক্রি ভালো হয়েছে। খরচ বাদ দিলে ২০ হাজার টাকার মতো লাভ হবে। কেউ কেউ আবার খাবার হোটেল-আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। খুলনার বাসিন্দা রামলাল বিহারী মজুমদার বলেন, ‘এর আগে কুয়াকাটায় এসে দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে যে রুমে থেকেছি, এবার সে রুমের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা রাখা হয়েছে।’

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে হাজারো মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো

ফাতেমা আক্তার মৌসুমী নামের এক পর্যটক বলেন, ‘কুয়াকাটায় রাস মেলা দেখার আগ্রহ নিয়ে এসেছিলাম। কলাপাড়ার পাখিমারা থেকে মহিপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়কের বেহালে সব আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। কুয়াকাটা পর্যটনের কথা ভেবে দ্রুত এ সড়কটি সংস্কার করা জরুরি। নইলে কুয়াকাটা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেবে।’
স্নান শেষে পুণ্যার্থীরা কলাপাড়া পৌর শহরের মদন মোহন সেবাশ্রমে এসে সমবেত হতে শুরু করেন। ১১৭ বছর ধরে এখানে ধর্মীয় আচার পালন করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। যার জন্য রাধাকৃষ্ণের ১৭ জোড়া যুগল মূর্তি এ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হাজার হাজার রাসভক্ত স্নান শেষে রাধাকৃষ্ণের এসব যুগল মূর্তি দর্শন করে যাঁর যাঁর বাড়িতে ফিরে যাবেন। তা ছাড়া প্রতিবছরের মতো এ বছরও কলাপাড়া পৌর শহরের মদন মোহন সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে তিন দিনের মেলা বসেছে। নানা পণ্যের পসরা নিয়ে মেলায় এসেছেন দোকানিরা। মেলাপ্রাঙ্গণ ছাড়াও আশপাশের রাস্তায়ও বসেছে অসংখ্য দোকানপাট।
কলাপাড়ার মদন মোহন সেবাশ্রমের সাধারণ সম্পাদক নাথুরাম ভৌমিক বলেন, ১৯২৭ সাল থেকে কলাপাড়া-কুয়াকাটাতে রাস পূজা হচ্ছে। অন্য বছরগুলোর চেয়ে এবার পুণ্যার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ছিল। উপজেলা প্রশাসন সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।