করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশের ৪৩টি জেলায় এখন লকডাউন (অবরুদ্ধ) চলছে। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী, এসব জেলায় সড়ক ও নৌপথে প্রবেশ এবং বের হওয়া নিষিদ্ধ। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে জেলার অভ্যন্তরের যাতায়াতেও। কিন্তু এই বিধিনিষেধের অনেকটাই কার্যত কাগজে–কলমে। মানুষ ঘরে না থাকায় বাস্তবে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। ফলে এসব জেলার বাইরেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে একমাত্র রাঙামাটি ছাড়া বাকি সব জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের তথ্য প্রচার করা হয়। এরপর থেকে দেশে এখন মোট রোগী ৮ হাজার ৭৯০ জন। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বিভিন্ন জেলা-উপজেলা লকডাউন ঘোষণা করে প্রশাসন। ৭ এপ্রিল প্রথম নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলা লকডাউন করা হয়।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণসংক্রান্ত তথ্যের সরকারি ওয়েবসাইটের (https://corona.gov.bd) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শনিবার পর্যন্ত দেশের ৪৯টি জেলা সম্পূর্ণ লকডাউন। তবে এর মধ্যে ৬টি জেলা এখনো স্থানীয় প্রশাসন লকডাউন ঘোষণা করেনি বলে জানা গেছে। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত দেশের ৪৩টি জেলা পুরোপুরি লকডাউন ছিল। এর বাইরে বেশ কিছু জেলার অনেকগুলো উপজেলা লকডাউন। লকডাউন ঘোষণা করা জেলার হাটবাজারগুলোতে মানুষের ভিড় হচ্ছে। সামাজিক দূরত্বও মানা হচ্ছে না।
রাজধানীর বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী আক্রান্ত নারায়ণগঞ্জ জেলায়। প্রথম যে দুটি জেলা লকডাউন করা হয়েছিল, তার একটি নারায়ণগঞ্জ। সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রস্থল নারায়ণগঞ্জ লকডাউন ঘোষণার পরও হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে যায়। এখান থেকেই বেশির ভাগ জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এখন আবার পোশাক কারখানা খুলেছে। অনেকে আবার ফিরছেন পোশাকশিল্প কারখানা–অধ্যুষিত এই জেলায়। গতকাল পর্যন্ত এই জেলায় করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১ জন। এর মধ্যে ৪৬ জন মারা গেছেন।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর নেই। গার্মেন্টস খুলে দেওয়া মানে সবকিছু খুলে গেছে তা নয়। লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, মানুষ নানা অজুহাতে বের হচ্ছে। তাদের ওপর বল প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। মানুষ সচেতন না হলে লকডাউন কার্যকর করা কঠিন।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের বাইরে যে ৬টি জেলাকে সরকারি ওয়েবসাইটে পুরোপুরি লকডাউন দেখানো হয়েছে, সেগুলো হলো ফেনী, খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা ও লালমনিরহাট।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে ১০টি জেলা লকডাউন। সেগুলো হলো গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর। এ ছাড়া ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলা, ঢাকার সাভার ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা লকডাউন চলছে। তবে সরকারি হিসাবে এই বিভাগের কিশোরগঞ্জ জেলাও লকডাউন।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন রয়েছে ছয়টি জেলা—কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলার মধ্যে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, হাটহাজারী ও রাউজান—এই ৬টি উপজেলা লকডাউন আছে। এ ছাড়া বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি ও লামা উপজেলা আংশিক লকডাউন। তবে সরকারি হিসাবে এই বিভাগের ফেনী ও খাগড়াছড়ি জেলাও লকডাউন।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও নড়াইল জেলা। এ ছাড়া মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা লকডাউন। তবে সরকারের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলাও লকডাউন।
রংপুর বিভাগের ৮টি জেলার মধ্যে রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম—এই ৭টি লকডাউন চলছে। অবশ্য সরকারি ওয়েবসাইটে লালমনিরহাট জেলাকেও লকডাউন দেখানো হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, জয়পুরহাট ও বগুড়া—এই ৫টি লকডাউন। আংশিক লকডাউনে আছে সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলা।
বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার মধ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা—এই ৪টি লকডাউন। সিলেট বিভাগের চারটি এবং ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলার সবই লকডাউন। অবশ্য জেলাগুলোকে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। রাজধানীর পাশের জেলা পোশাকশিল্প কারখানা–অধ্যুষিত গাজীপুরেও লকডাউন মেনে ঘরে থাকার প্রবণতা কম। এখন পর্যন্ত এই জেলায় আক্রান্ত রোগী ৩৩৩ জন।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামছুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে লকডাউনও চলছে আবার পোশাক কারখানাও চলছে। তাই শ্রমিকেরা লকডাউন অনেকটাই মানছেন না।