করোনার সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে স্কুল-কলেজ, কলকারখানা, অফিস-আদালত বন্ধ আছে। সর্বশেষ এই বন্ধের মেয়াদ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ স্কুল–কলেজ, অফিস–আদালতের ছোট–বড় ভবন দেড় মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকবে। এ তো গেল বাংলাদেশের চিত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও চলছে একই ধরনের লকডাউন। ফলে করোনার দুশ্চিন্তার মধ্যে এই বন্ধ বড় ভবনগুলো জীবাণুমুক্ত করা, বিশেষ করে ভবনের ট্যাংক, পানির পাইপলাইনে জমে থাকা পানি ও লাইন জীবাণুমুক্ত করা বিশ্বের দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এসব ভবন বা স্থাপনায় নানা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ নানা ধরনের জীবাণু জন্ম নিতে পারে। বিশেষ করে এসব স্থাপনা বা ভবনে ব্যবহারের জন্য পানি জমিয়ে রাখার স্থান ও সরবরাহ লাইনে জীবাণু জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ নিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’–এ বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। ‘নেচার’ বলছে, বিভিন্ন ভবনের পানির পাইপে দীর্ঘদিন জমে থাকা পানিতে নানা ধরনের ক্ষতিকর জীবাণু জন্ম নিতে পারে। ফলে ব্যবহারের আগে অবশ্যই তা জীবাণুমুক্ত কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ব্যবহারকারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বেন।
কোভিড-১৯–এর কারণে লকডাউনের সময় বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর কী ধরনের হুমকি তৈরি করেছে, তা নিয়ে গত ২৮ এপ্রিল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নেচার রিসার্চ জার্নাল। নেচারের প্রতিবেদন বলছে, লকডাউনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এসব স্থাপনায় দীর্ঘদিন জমে থাকা পানিতে ক্ষতিকারক নানা ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিয়েছে। এর মধ্যে বড় হুমকি লেজিওনেলা নামের ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমিত হয়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানির ব্যাপারে বন্ধ প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই সতর্ক হওয়া জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানাসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। সংগত কারণে দীর্ঘদিনের জমে থাকা পানিতে ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক জীবাণু তৈরি হবে। প্রতিষ্ঠান খোলার আগে যদি এসব পানি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত না করা হয়, তাহলে তা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে। কলকারখানা, অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্ডারগ্রাউন্ড এবং ট্যাংকে যেসব পানি জমে আছে, সেগুলো স্যানিটাইজ করতে হবে। তা না হলে জীবাণুযুক্ত পানি থেকে ডায়রিয়াল টাইপের ডিজিজসহ নানা ধরনের রোগ আমাদের মধ্যে ছড়াবে।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে পানি জমে থাকলে সেখানে তৈরি হয় নানা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ নানা ধরনের জীবাণু। করোনাভাইরাসের কারণে এক মাসের বেশি সময় ধরে কলকারখানাসহ সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানের পানি রাখার ট্যাংকসহ নানা স্থানে পানি জমে আছে দিনের পর দিন। আর এসব পানিতে জন্মেছে নানা ধরনের ক্ষতিকারক জীবাণু।
স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, ‘লকডাউনের সময় জমে থাকা পানি আমাদের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এখনই যদি জমে থাকা পানি আমরা জীবাণুমুক্ত না করতে পারি, তাহলে এখান থেকে যে ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়াবে। তা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করবে।’ পাশাপাশি ভবনের খোলা স্থানে জমা থাকা পানিতে এডিস মশা জন্মাবে, এটা তো স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। এরপর করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ১৭ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তী সময়ে গত ২৬ মার্চ থেকে যানবাহন, সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান, আদালত বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত বলে চিহ্নিত হয়েছে ৮ হাজার ৭৯০ জন। মারা গেছেন ১৭৫ জন।
জমে থাকা পানি যে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে তা স্বীকার করেন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চিকিৎসক মো. মোমিনুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের এই বন্ধের সময়ে সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনায় জমে থাকা পানি এবং নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি আমাদের জন্য হুমকি। আমরা যদি এসব পানি ফেলে না দিই কিংবা জীবাণুমুক্ত না করি, তাহলে কিন্তু আমাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হবে। সিটি করপোরেশনসহ সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে সচেতন হয়ে জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে এবং পানি রাখার স্থান জীবাণুমুক্ত করতে হবে। তবেই আমরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাব।’
স্থপতি ইকবাল হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি যেসব নির্মাণকাজ চলছে, যেসব স্থানে পানি জমে আছে, সেগুলো যেন দ্রুত অপসারণ কিংবা জীবাণুমুক্ত করা হয়। আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের সংক্রামক রোগের ইতিহাস ঘেঁটে দেখি, আমরা দেখতে পাব, দীর্ঘদিন জমে থাকা পানি থেকেই কিন্তু সংক্রামক রোগ ছড়িয়েছে। এডিস মশা লার্ভা কিন্তু জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়।’
উদ্বেগের কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহফুজুল হক বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়াটার প্ল্যান্টে জমে থাকা পানিতে অধিক পরিমাণ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার জন্ম নেয়। তিনি বলেন, ‘স্টেগন্যান্ট ওয়াটার (জমা পানি) থাকলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্মাবেই। ইউনিভার্সালি ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য হলো পানি। আর ব্যাকটেরিয়া কিন্তু আমাদের খাবার চেইনের ভেতর ঢুকে যাবে। আমাদের দেশে বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ আছে, যেগুলো আনকমন। ফলে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কলকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানি যত দ্রুত সম্ভব জীবাণুমুক্ত করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে বন্ধ থাকা নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই কিন্তু পানি জমে আছে দীর্ঘদিন। আর এসব পানিতে অবশ্যই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ক্ষতিকারক জীবাণু জন্ম নিয়েছে। প্রতিষ্ঠান খোলার আগে যদি এসব পানি আমরা জীবাণুমুক্ত না করি কিংবা পানি রাখার পাত্র যদি জীবাণুমক্ত না করি, তাহলে কিন্তু বিপদ হবে। তাই প্রতিষ্ঠান খোলার আগে অবশ্যই এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে জমে থাকা জীবাণুযুক্ত পানি নানা সংক্রামক রোগ ছড়াবে।’
অবশ্য বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানি অপসারণ করা হচ্ছে বলে জানান ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকা সরকারি অফিস-আদালত এবং নানা সরকারি স্থাপনা যাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়, সে ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়। এ ব্যাপারে আমরা তৎপর আছি। আমরা জানি, জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়, যা আমাদের জন্য বড় হুমকি।’
বাসাবাড়ি, ভবন কিংবা প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়ার আহ্বান জানান ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো জানি, জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। তাই বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি আমাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই জমে থাকা পানি ফেলে দিন।’
অবশ্য বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে মানুষ মোটেও আন্তরিক নয় বলে মন্তব্য করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে কলকারখানা, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সেখানকার নানা স্থানে পানি জমেছে। এমনিতে স্কুল চালু থাকলেও তখন সেই স্কুলের পেছনে পড়ে থাকা বোতলের পানি কিন্তু আমরা পরিষ্কার করি না। ফ্যাক্টরির ছাদেও যদি পানি জমে, সেগুলোও কিন্তু তো আমরা পরিষ্কার করি না।’