র্যাগিং কী ও কেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের হল হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য একধরনের আশীর্বাদ। হলে থাকতে পারা শিক্ষার্থীদের জন্য একটা সৌভাগ্যের বিষয়। পড়ালেখার জন্য হল একটা দারুণ জায়গা। থাকা–খাওয়ার একটা কম খরচে বন্দোবস্ত হয় হলে। হল হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার সূতিকাগার। হল হচ্ছে এক অন্য ধরনের বিদ্যাপিঠ। হলে শিক্ষার্থীদের আচার–আচরণের একটা প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে থাকার ফলে বৈচিত্র্যময় জীবনের অভিজ্ঞতা হয়।

এই হল না পাওয়া অনেকের জন্য একটা কষ্টের বা দুঃখের কারণ যেমন হয় তেমনি হল পাওয়াও অনেকের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে। হলে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে এক বিরক্তিকর ও জঘন্যতম সমস্যার নাম হচ্ছে র‍্যাগিং।

র‍্যাগিং কথার অর্থ দাঁড়ায় ছিন্নবস্ত্র। তবে হলে হলে এর অন্য কিছু নাম আছে।

একে হলে পরিচিত হওয়া বা ম্যানার শেখানো বলা হয়। পরিচিত হওয়া বা ম্যানার শেখানো খুব ভালো কাজ। এতে দোষের কিছু নেই। ছোটরা বড়দের কাছ থেকেই শিখবে, এটাই স্বাভাবিক। সবার সঙ্গে সবার ভালো পরিচয় হবে, এটাও অতি স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই পরিচিত হওয়া বা ম্যানার শেখানোর নাম করে নতুনদের ওপর করা অত্যাচার। একটা মানুষ নতুন একটা জায়গায় এলে সে মানসিকভাবে এমনিতেই বিপর্যস্ত থাকে। সেই অবস্থায় তাকে নিয়ে মজা করা অত্যন্ত অপরাধের একটা কাজ।

নতুনদের জোর করে সালাম দিতে বলা হয়। সালাম দেওয়া অনেক ভালো কাজ, কিন্তু সেটা কেন জোরপূর্বক করাতে হবে? আর কেউ যদি সালাম দিতে ভুল করে তাহলে তাকে পেতে হয় শাস্তি।

অনেক ক্ষেত্রে নতুনদের বলা হয় চেয়ার-টেবিলকেও সালাম দিতে হবে। সালাম দেওয়া ছাড়া আরও থাকে পোশাক পরাসহ নানা ধরনের বিষয়। এগুলো নতুনদের ধরা হয়। নিজেদের রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। ছিন্নবস্ত্র র‍্যাগিংয়ের যেহেতু অর্থ, সেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই ছিন্নবস্ত্রও করা হয়। চেয়ার বা টেবিলের নিচ দিয়ে আসা–যাওয়া করানো হয়। ম্যাচের কাঠি দিয়ে ঘর পরিমাপ করানো।

প্রতীকী ছবি

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবাকে ফোন দিয়ে বাজে কথা বলা হয়। মেয়েদের সঙ্গে বাজে আচরণ করতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নতুনদের মাদক হাতে তুলে দেওয়া হয়। জোর করে নেশা করানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্ররাই নেশাগ্রস্ত হওয়া শেখেন বড় ভাইদের কাছ থেকে।

র‍্যাগিংয়ের কারণে পড়ালেখা দারুণভাবে ব্যাহত হয়। অনেক ছাত্ররা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। র‍্যাগিংয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো র‍্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনের বেশি কিছু করার থাকেও না। রাজনৈতিক কারণে যাঁরা র‍্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠে না প্রশাসন।

র‍্যাগিংয়ের ঘটনা মেয়েদের হলেও অপরিচিত নয়। মেয়েদের হলেও মারাত্মক রকমের র‍্যাগিং হয়ে থাকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড পর্যায়ক্রমিকভাবে চলে আসছে।

দিন দিন র‍্যাগিং হয়ে উঠছে এক আতঙ্কের নাম। নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য এক বিভীষিকা এই প্রথা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে, অন্যথায় বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে আমাদের প্রজন্ম।

এখন কথা হচ্ছে র‍্যাগিং খুবই খারাপ কাজ কিন্তু এই র‍্যাগিংয়ের একটা উল্টো দিক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন নতুন ব্যাচ আসে, তখন ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ের প্রয়োজন পড়ে। নতুনদের সব সমস্যার সমাধান কিন্তু প্রসাশনের কাছে থাকে না। আর প্রশাসনের কাছে সব শিক্ষার্থীরা যেতেও পারেন না। এ জন্য সবার অবশ্যই দরকার পড়ে অগ্রজদের সহযোগিতা। তাই অনুজ–অগ্রজ ভালো সম্পর্ক তৈরি হওয়া খুবই জরুরি বিষয়। এই সম্পর্ক তৈরির জন্য সিনিয়ররা হয়তো জুনিয়রদের ডাকেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় পর্ব খারাপ দিকে গেলেও কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু উদ্দেশ্য সৎ থাকে। সিনিয়ররা ভালোর জন্য ডেকে বিনা কারণে প্রশাসনের কাছে শাস্তি পেয়েছেন, এমন ঘটনার নজিরও রয়েছে। এটা অবশ্য প্রসাশনের অন্য একটা টেকনিকও বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরাতনরা নতুনদের সঙ্গে কথা বলবেন না এমন হতে পারে না। তাঁদের মধ্যে সুন্দর সখ্য গড়ে উঠবে, এমনটাই কাম্য। কিন্তু প্রসাশন সেটা চায় না। তারা চায় ছাত্ররা তাদের আয়ত্তে থাকুক, যাতে কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করতে না পারেন, কথা বলতে না পারেন। নতুন ছাত্ররা প্রতিবাদী বা মুক্তমনা হয়ে উঠবেন, এটা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছেই কষ্টের।

প্রতীকী ছবি

তাই নির্মূল করতে হবে দুই জায়গার সমস্যাই। ছাত্রদের কর্তৃক র‍্যাগিং নামের ভয়াবহ কালচার বন্ধ করতে হবে। আর অন্যদিকে প্রসাশন তাদের সব অনিয়ম ঢাকতে নতুনদের যে পুরাতনের সঙ্গে মিশতে দেয় না, তা–ও বন্ধ করতে হবে।

র‍্যাগিং আসলে একটি সংক্রামক ব্যাধির মতো হয়ে গেছে। এটা এখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। এই প্রথা ছড়িয়ে গেছে স্কুল–কলেজেও। নতুন কেউ এলে তাকে ধরে যাচ্ছেতাই আচরণ করাই হচ্ছে র‍্যাগদাতাদের মূল উদ্দেশ্য। নতুন ছাত্রদের ‘মুরগি’ বলে আখ্যা দেওয়া হয় এই র‍্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে। একটা মুরগি দেখলেই শিয়াল যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি ঝাঁপিয়ে পড়েন র‍্যাগদাতারা। র‍্যাগিং আবার বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হতে থাকে বছরের পর বছর। যাঁরা এক বছর প্রচুর র‍্যাগের শিকার হন, তাঁরা আবার পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করেন র‍্যাগ দেওয়ার জন্য। এই অপেক্ষা যেন এক পৈশাচিক আনন্দের। কখন আসবে সেই সুদিন, কখন আসবেন নতুন ছাত্ররা। এ এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। একে অপরের চেয়ে বেশি র‍্যাগ দেওয়ার লড়াই লেগে যায়। কে কত বেশি ভয়ানক র‍্যাগ দিতে পারেন, তা নিয়েও থাকে নানা যুদ্ধ। এমনকি যাঁরা জীবনে র‍্যাগের শিকার হননি কিংবা র‍্যাগের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছেন, শিক্ষকদের কাছে র‍্যাগ দিয়েছেন, তাঁরা আগ্রহ দেখান র‍্যাগের জন্য। তাঁদের র‍্যাগ দেওয়ার ধরনও থাকে ভয়ানক।

র‍্যাগিংয়ের আরেকটা দিক হচ্ছে প্রভাব খাটানো। অনেক সিনিয়ররা র‍্যাগ দেওয়ার জন্য জুনিয়রদের ডাকেন না। ডাকেন নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা নিজের দল ভারী করার জন্য জুনিয়রদের ডেকে নানা ধরনের কথা শোনান। দলে বাগানোর জন্য প্রলোভন দেন। নিজের মিছিলে বা কোরামে লোক বাড়ানোর জন্য অপব্যবহার করেন জুনিয়রদের। অনেকেই আবার প্র্যাকটিক্যাল বা অন্যান্য প্রজেক্টের কাজ করানোর জন্য ডেকে আনেন জুনিয়রদের। এটা আবার অনেক জায়গায় বাধ্যতামূলক কর্মকাণ্ডের একটি অংশও।

ছেলেরা প্রেম করার জন্য জুনিয়র মেয়েদের হাতিয়ার হিসেবে খুঁজে নেন। অনেকেই মেয়েদের বাধ্য করেন ঘুরতে বের হওয়ার জন্য বা দেখা করার জন্য।

নানা জনের নানা মত, নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে এ বিষয়ে। সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। প্রশাসন ও দায়িত্বশীল সবাইকে হতে হবে সচেতন।