রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের পদক্ষেপ যথেষ্ট মনে করেন না আন্তর্জাতিক বিচার আদালত।
বিশ্বে আইনের শাসন ও মানবতার মর্যাদা রক্ষায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। জানালেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সহিংসতা ও বৈষম্যের নীতিতে গণহত্যার উদ্দেশ্য থেকে থাকতে পারে। আদালত সেই বিবেচনা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে আদালত সর্বসম্মতভাবে মিয়ানমারের প্রতি যে চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, এগুলো মেনে চলা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক।
অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে: ১. গণহত্যা সনদের বিধি ২ অনুযায়ী মিয়ানমারকে তার সীমানার মধ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যা, জখম বা মানসিকভাবে আঘাত করা, পুরো জনগোষ্ঠী বা তার অংশবিশেষকে নিশ্চিহ্ন করা এবং তাদের জন্মদান বন্ধের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত থাকতে হবে। ২. মিয়ানমারকে অবশ্যই তার সীমানার মধ্যে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট বা তাদের সমর্থনে অন্য কেউ যাতে গণহত্যা সংঘটন, গণহত্যার ষড়যন্ত্র, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে গণহত্যার জন্য উসকানি দেওয়া, গণহত্যার চেষ্টা করা বা গণহত্যার সহযোগী হতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ৩. গণহত্যা সনদের বিধি ২–এর আলোকে গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্যপ্রমাণ রক্ষা এবং তার ধ্বংস সাধনের চেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে। ৪. এই আদেশ জারির দিন থেকে চার মাসের মধ্যে আদালতের আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আদালতকে জানাতে হবে। এরপর থেকে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পরপর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অপূরণীয় বৈষম্য ও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি আবশ্যকতার বিষয়ে আদালত বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার যে পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হোক না কেন, গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণে রাষ্ট্রটি বাধ্য। মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, জাতিগত সমঝোতা এবং রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, আদালত সেগুলোকে যথেষ্ট মনে করছেন না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকারসমূহের ক্ষেত্রে যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধনের কার্যক্রম চলছে, তার বিপরীতে মিয়ানমারের এসব পদক্ষেপকে আদালত যথেষ্ট মনে করছেন না। আদালত এ বিষয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের ভাষ্য উল্লেখ করেছেন। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল: রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি উদ্বাস্তু এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের তাঁদের আদি জায়গায় স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে ফিরে আসার মতো প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণের মতো হয়নি।
নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে শান্তি প্রাসাদে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আদালতের আনুষ্ঠানিক অধিবেশনে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের (আইসিজে) প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ আনুষ্ঠানিকভাবে এই আদেশ ঘোষণা করেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘ কয়েক দশকের জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের পটভূমিতে গাম্বিয়া এই সুরক্ষার আবেদন করে।
মিয়ানমার ও গাম্বিয়া উভয়েই ১৯৪৯ সালে গৃহীত গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে মিয়ানমারকে বাধ্য করার লক্ষ্যেই গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়। গত ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১২ তারিখ তিন দিন এই আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়, যাতে উভয় পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। আন্তর্জাতিক আদালতের ১৫ জন স্থায়ী বিচারপতির সঙ্গে দুই বিরোধীয় রাষ্ট্রের মনোনীত দুজন অ্যাডহক বিচারপতি মামলার শুনানি গ্রহণ করেন।
মিয়ানমারের সরকারপ্রধান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি শুনানিতে অংশ নিলেও গতকাল তিনি আদালতে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর জায়গায় মিয়ানমারের বিকল্প প্রতিনিধি স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের ইউনিয়ন মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ে আদালতে হাজির ছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ঘোষণার পর তাঁর কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য না করেই আদালত ত্যাগ করেন।
গাম্বিয়ার পক্ষে দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তামবাদু গতকাল আদালতে হাজির ছিলেন। এর আগে ডিসেম্বরে শুনানিতে তিনি দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আদেশের পর তিনি এটিকে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ নিপীড়ন ও বঞ্চনার অবসানের পথে একটি ছোট পদক্ষেপ অভিহিত করে বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
গণহত্যার শিকার ও উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সদস্যদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত কয়েকজন প্রতিনিধি এই আদেশকে ঐতিহাসিক মাইলফলক অভিহিত করে বলেছেন, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এবং অন্য সবার সমান মর্যাদা পাওয়ার যে অনুভূতি, এই আদেশে তাঁরা সেটা ফিরে পেয়েছেন। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের ইয়াসমিন উল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী জনগোষ্ঠীর যে স্বীকৃতি আদালত দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
২৫ পৃষ্ঠার এই লিখিত আদেশের শুরুতেই আদালত গণহত্যা সনদের আলোকে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের বিরোধ নিষ্পত্তিতে আদালতের এখতিয়ারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন। আদালত বলেছেন যে গণহত্যা ঘটেছে কি ঘটেনি, সেটি বিচারের ওপর আদালতের এখতিয়ার সীমাবদ্ধ নয়। গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা অনুসরণে কোনো স্বাক্ষরকারী দেশ ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে সনদে অংশগ্রহণকারী অন্য যেকোনো দেশ আপত্তি জানালে তা নিষ্পত্তির এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। এই বিরোধের বিষয়ে গাম্বিয়া ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) প্রতিভূ (প্রক্সি) হিসেবে মামলা করেছে বলে মিয়ানমার আবেদনটি খারিজ করার যে দাবি জানিয়েছিল, আদালত তা খারিজ করে দেন। আদালত বলেছেন, গাম্বিয়া তার নিজস্ব পরিচয়েই মামলা করেছে এবং ওআইসিসহ অন্য যেকোনো সংস্থার সহায়তা নেওয়ার অধিকার তার রয়েছে।
মামলার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে গাম্বিয়ার কোনো বিরোধ ছিল না—এমন দাবিও আদালত নাকচ করে দিয়েছেন। মিয়ানমারকে গাম্বিয়া গত বছরের ১১ অক্টোবর কূটনৈতিক চিঠির মাধ্যমে সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার বিষয়ে যে দাবি জানিয়েছিল, তার কোনো জবাব না দেওয়া উভয় দেশের মধ্যে বিরোধের আরেকটি আলামত বলে আদালত মন্তব্য করেছেন। মিয়ানমার দাবি করেছিল, দেশটির সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত কার্যক্রম গণহত্যা সনদের আওতায় গণহত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত বলে গণ্য করা যায় না। মিয়ানমারের এমন দাবির বিষয়ে আদালত বলেছেন, গণহত্যা ঘটেছে কি ঘটেনি, তা এই পর্যায়ে বিচার্য নয় এবং গাম্বিয়ার অভিযোগ অনুযায়ী কিছু কিছু কার্যক্রম সনদের শর্তগুলো পূরণ করে। গণহত্যা সনদের আওতায় রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা, তার প্রয়োগ ও প্রতিপালন বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রশ্নে এসব কারণ আপাতদৃশ্যে (প্রাইমা ফেসি) বিচার্য বলে আদালত মতপ্রকাশ করেন।
এরপর আদালত গাম্বিয়া মামলাটি করতে পারে না বলে মিয়ানমারের দাবির বিষয়টিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ দেন। আদালত তাঁর সিদ্ধান্তে বলেন, শুধু সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রই মামলা করার অধিকার রাখে, এমন দাবি ঠিক নয়। গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে অভিন্ন স্বার্থে সনদে অংশগ্রহণকারী যেকোনো রাষ্ট্র মামলা করার অধিকার রাখে এবং গাম্বিয়ার সেই অধিকার আছে।
যাদের সুরক্ষা চাওয়া হয়েছে, তাদের অধিকারের সঙ্গে দাবিকৃত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়ে আদালত বলেছেন, সনদের ৪১ বিধির আওতায় মূল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা বিচারের আগেই ওই জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় অন্তর্বর্তী নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার ও ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। আদালত এ ক্ষেত্রে শুনানিতে মিয়ানমারের সাফাইয়ে দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। মিয়ানমার বলেছিল, ২০১৭ সালের কথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের সময়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে অনানুপাতিক হারে শক্তি প্রয়োগ করেছে এবং বেসামরিক নাগরিক ও আরসা যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য করেনি, এমনটা বলা যাবে না। আদালত জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলের ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে ‘আর্ন্তজাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন ঘটেছে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে’ বলে যে উপসংহার টানা হয়েছে, তা উল্লেখ করেন। এসব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের আলোকে গাম্বিয়া যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন করেছিল, সেগুলোর প্রথম তিনটি রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে আদালত অভিমত দেন।
আদালতের ১৫ জন স্থায়ী সদস্য এবং গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত দুজন অ্যাডহক বিচারপতির সবাই অন্তর্বর্তী আদেশগুলোর বিষয়ে একমত হলেও আদালতের ভাইস প্রেসিডেন্ট, একজন স্থায়ী বিচারপতি এবং একজন অ্যাডহক বিচারপতি দু-একটি বিষয়ে ভিন্নমত দেন। তাঁদের সেসব ভিন্নমতও প্রকাশ করা হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট চীনের বিচারপতি সু হানকিন গণহত্যা সনদের বিধানসমূহের আলোকে গণহত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকতে পারে, এমনটি মনে করেন না। তবে যে মাত্রায় রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ সংঘটিত হয়েছে, তা অন্তর্বর্তী নির্দেশনা জারির জন্য যথেষ্ট বলে তিনি মতামত দিয়েছেন।
বিপরীতে, অন্যতম স্থায়ী বিচারপতি কনচাতো ত্রিনদাদে জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী দল এবং জাতিসংঘের অন্য সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বর্ণিত রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও বৈষম্য কতটা গুরুতর, তা তুলে ধরে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে’ বিষয়টা এতটা সাধারণ নয় বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।
মিয়ানমারের মনোনীত বিচারপতি ক্লাউস ক্রেস অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলোর বিষয়ে সম্মত হয়েও আলাদা ঘোষণায় বলেছেন, এই অন্তর্বর্তী আদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে সুরক্ষামূলক। আদালত গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল কি না, সে বিষয়ে বিস্তারিত নিরীক্ষা করেননি। আদালতের এই আদেশ মূল মামলার গুণাগুণ বিচারের বিষয়ে কোনো প্রভাব ফেলে না।