সচিবালয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে। এ সময় তাঁকে হেনস্তা করা হয়। স্বজনদের দাবি, শারীরিক ও মানসিকভাবে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। চিকিৎসার পরিবর্তে তাঁকে থানায় এনে মামলা দেওয়া হয়।
দীর্ঘক্ষণ সচিবালয়ের একটি কক্ষে আটক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন রোজিনা ইসলাম। সচিবালয় থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ সাংবাদিকদের প্রথমে জানায়, রোজিনা ইসলামকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হবে। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে শাহবাগ থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পৌনে নয়টার দিকে তাঁকে থানায় আনা হয়।
শাহবাগ থানায় আনার পর রাতভর রোজিনা ইসলামের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে গড়িমসি করে শাহবাগ থানার পুলিশ। এ সময় পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বলেন। তবে সে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
রাত ১১টার দিকে শাহবাগ থানা থেকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধ থানায় অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ সাংবাদিকদের ব্রিফ করে একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানায়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাতে রোজিনা ইসলামকে থানাতেই রাখা হবে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গতকাল সোমবার করোনার দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেন। দীর্ঘক্ষণ সচিবালয়ের হেনস্তার শিকার হয়ে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শাহবাগ থানায় তাঁকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে রাখা হয়। স্বজনদের মাধ্যমে আনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ রাতে তাঁকে দেওয়া হয়।
তাঁকে শাহবাগ থানায় আনার পরই বিভিন্ন গণমাধ্যমের শতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত হন। তাঁরা এ সময় রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
দিবাগত রাত দেড়টায় হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে যে রোজিনা ইসলামকে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হবে। এ সময় থানার ভেতরের প্রাঙ্গণে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ঢুকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতেও দেখা যায়। এ নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোজিনা ইসলামকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হবে। রোজিনার পরিবারের সদস্যরাও এতে আপত্তি জানান।
রাত আড়াইটার দিকে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন তাঁর স্বামী মনিরুল ইসলাম। তিনি দেখা করে এসে সাংবাদিকদের বলেন, রোজিনা ইসলামকে চিকিৎসার ব্যবস্থা দিতে পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে চায়। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে।
পরিবারের প্রথমে দাবি ছিল, রাজধানীর কোনো বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে তাঁকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু শাহবাগ থানার পুলিশ তা মানতে নারাজ। এ সময় স্বজনেরা শাহবাগ মোড়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজিনা ইসলামকে নেওয়ার অনুরোধ করেন। সেটিতেও আপত্তি জানান শাহবাগ থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। অথচ এর কিছুক্ষণ আগেও থানা-পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছিলেন যে রোজিনা ইসলামের চিকিৎসা দরকার। কিন্তু আপত্তি জানানোর পর চিকিৎসা নিয়ে আর কথা বলেননি তাঁরা।
ভোররাত চারটার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের থানা প্রাঙ্গণের বাইরে চলে যেতে বলেন। এ সময় সাংবাদিকেরা বের হতে থাকেন। এডিসি তখন সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমিনকে বের হয়ে যেতে বলেন। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকেরা এর প্রতিবাদ জানালে তাঁদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন পুলিশের সদস্যরা।
উত্তেজিত পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এ সময় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সাংবাদিক মো. জাহিদুল ইসলাম ভিডিও করছিলেন বলে তাঁর ফোন কেড়ে নেন। রোজিনা ইসলামকে নারী পুলিশ দিয়ে জেলহাজতে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। রোজিনা ইসলামের বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন পুলিশের সদস্যরা। তাঁদের থানা প্রাঙ্গণের বাইরে বের করে দেওয়া হয়।
শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুর রহমান সরদার একই সময়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ও স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সেখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের জনা বিশেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকেরা সবাই মিলে প্রতিবাদ জানালে তাঁদের সঙ্গে আবারও খারাপ ব্যবহার করেন পুলিশের সদস্যরা। থানা প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার পর সেই সাংবাদিকের ফোন ফেরত দেওয়া হয়।
এরপর থানার মূল গেটের সামনের ফুটপাতে সাংবাদিক ও স্বজনেরা অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণ পর এডিসি হারুন অর রশীদ গেটের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে এসে বলেন, শাহবাগ থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন, কেপিআই)। এ কারণে তিনি সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘থানায় অন্য মানুষ, অনেক আসামি, গোলাবারুদ এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি আছে। আপনারা ভেতরে থাকলে নিরাপত্তার সমস্যা হতে পারে।’ তাঁর দুর্ব্যবহার মনে না রাখার অনুরোধ করেন।
সকাল পৌনে আটটায় হঠাৎ করেই শাহবাগ থানা থেকে রোজিনা ইসলামকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে আনা হয়। সাধারণত এত সকালে এই আদালতে আনার তেমন নজির নেই। রোজিনা ইসলামকে সেখানে এনে সরাসরি আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। পরে আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার একটু পর রোজিনা ইসলামকে সিএমএম আদালতে তোলা হলে ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম শুনানি শেষে তাঁর রিমান্ড নাকচ করেন। শাহবাগ থানা পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছিল।