প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ প্রণোদনার প্রস্তাব করে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী।
* প্রবাসী আয় ৩৫% বাড়তে পারে এ বছর। আগামী বছর ২০% বাড়ার সম্ভাবনা।
* হুন্ডি চালু হলে কমতে পারে প্রবাসী আয়।
* প্রণোদনায় ভর্তুকি লাগবে ৪ হাজার কোটি টাকা।
করোনা মহামারির প্রভাব কেটে গেলে অবৈধ পথে টাকা লেনদেন আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। এতে টানা বাড়তে থাকা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আবার কমতে পারে। তাই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়, বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের ধারাটি অব্যাহত রাখতে পারলে এবং আরও বেগবান করতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহের বর্তমান ধারা অদূর ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। তাই প্রবাসীদের উৎসাহী করতে বিদ্যমান ২ শতাংশের প্রণোদনা বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা যেতে পারে। এ খাতে সরকারের অতিরিক্ত ৪ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এটি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীদের বৈধ পথে টাকা পাঠানোর উৎসাহ ধরে রাখতে হবে। তাই সরকার যদি প্রস্তাবটি বিবেচনা করে, তাহলে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির প্রবাহ অব্যাহত থাকবে।
প্রণোদনা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে গত ২৮ এপ্রিল চিঠি দিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। চিঠিতে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী উল্লেখ করেন, করোনার সময়েও প্রবাসী কর্মীদের কষ্টার্জিত আয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ বছর এটি ৩৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এটি আরও ২০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ২ শতাংশ প্রণোদনাকে মহামারির মধ্যেও প্রবাসী আয় বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই প্রবৃদ্ধির আরও বিভিন্ন কারণ ও ব্যাখ্যা দিয়েছে। তবে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোকেই প্রধান কারণ মনে করছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বৈধ পথে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রণোদনা যে ব্যাপক উৎসাহিত করেছে, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গমনাগমন ও আমদানি কমে যাওয়ায় হুন্ডি ব্যবসা কমে গেছে। ফলে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন প্রবাসী কর্মীরা।
তবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রণোদনার ভূমিকা পরিষ্কার নয়। প্রণোদনার অপব্যবহার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এটি বাড়ানোর আগে আরও বিশ্লেষণ দরকার। এ ছাড়া করোনার প্রভাবে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হবে এবার বাজেটের মূল দর্শন। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা বাড়ানো যৌক্তিক হবে না।
জানা গেছে, করোনার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবাসী আয় ২২ শতাংশ কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল বিশ্বব্যাংক। বাস্তবে দেখা যায়, ভারতে ৩২ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় প্রবাসী আয় বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাংলাদেশে। প্রণোদনার চেয়ে হুন্ডি বন্ধ হয়ে যাওয়াকেই প্রবাসী আয় বাড়ার অন্যতম কারণ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্যাংক ও অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২ শতাংশের পাশাপাশি বাড়তি ১ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে বেশ কিছু ব্যাংক। এর মধ্যে আছে অগ্রণী, রূপালী, ইসলামী ব্যাংক। মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী বিকাশ গত ডিসেম্বর থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি পাঠালে বাড়তি ১ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে।
করোনার পর অনানুষ্ঠানিক পথে টাকা পাঠানো আবার শুরু হতে পারে বলে মনে করছেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২ শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসী আয় বাড়াতে কাজে দিয়েছে। প্রবাসীরা এতে উপকৃত হয়েছেন। এটি আরও বাড়াতে গেলে বাড়তি চাপে পড়বে সরকার। এমনিতেই বাজেটের ওপর রাজস্ব আয়ের চাপ আছে। তবে প্রণোদনা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চার বছর ধরেই প্রবাসী আয় বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসী আয় আসে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ডলার। পরের বছর ২০১৭-১৮ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৮ কোটি ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ১ হাজার ৬৪১ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে সরকার। ওই বছর আসে ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই এসেছে ২ হাজার ৬৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে ঈদ সামনে রেখে এপ্রিলেই ২০৬ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ আগের বছর একই মাসে দেশে এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার। আর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলার আসে গত জুলাইয়ে।
অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজেটের ওপর চাপ কমাতে প্রয়োজনে প্রণোদনা বাড়ানোর প্রস্তাব ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যাঁরা বেশি টাকা পাঠান, প্রথমে তাঁদের এ সুবিধার বাইরে রাখতে পারে সরকার। কম আয়ের প্রবাসীদের প্রথমে এ সুবিধা দিয়ে এটি চালু করা যেতে পারে।
প্রণোদনা বাড়ানোর প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রামরু আরও আগেই এ দাবি জানিয়েছে। এটা নাগরিক সমাজের দাবি। এটি অবশ্যই কার্যকর হওয়া দরকার। আগামী বাজেটে এ দাবি আদায়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।