স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সমাপ্তিলগ্নে তিনটি প্রশ্ন নিয়ে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছিল দেশের তিনজন বরেণ্য জ্যেষ্ঠ নাগরিকের। এঁরা প্রত্যেকে মুক্তিযুদ্ধকালে কিংবা এর আগের উত্তাল রাজনৈতিক উত্থান–পতনের সময়ে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিসাব–নিকাশ নিয়ে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল এই তিনজনকে। তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
জাতি নানা রাজনৈতিক উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসে পৌঁছেছিল। আপনি নিজেও সেই ঘটনাক্রমের অংশ ছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কল্পনাটা আপনার কাছে কেমন ছিল?
একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ১০ এপ্রিল আমি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করি। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। লন্ডনে আইন পড়ার সময় ফারুক লেঘারিকে বিপুল ভোটে হারিয়ে আমি প্রথম বাঙালি হিসেবে পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হই। এই ফারুক লেঘারি পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ষাটের দশকে লন্ডনে আমরা কিছু ছাত্র–বন্ধুরা মিলে ‘উত্তরসূরী’ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম। এ সংগঠনের গোপন উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সে সময় ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টে (আইসিসিপিআর) প্রথম যে অধিকারটি লিপিবদ্ধ হয়েছিল সেটা হলো সব মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। তখন থেকেই আমার মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দানা বাঁধে। যাহোক, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। বাংলাদেশের এই প্রথম সরকার চলমান ছিল ১৯৭৩ সালের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত। স্বাধীনতার ঘোষণাত্র ছিল বাংলাদেশের প্রথম দলিল। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত এর ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মূলত বাস্তব তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ ও যুক্তি, যার ভিত্তিতে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চর্চা করতে চেয়েছিলাম। এর সঙ্গে তিনটি প্রত্যয়ের কথা আমরা বলেছিলাম—সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। এই তিন প্রত্যয়ের মধ্যেই নিহিত ছিল আমাদের রাষ্ট্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার সঙ্গে আপনার কল্পনার রাষ্ট্রের কোথায় মিল, কোথায় অমিল?
এই যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তিনটি মুখ্য প্রতিপাদ্যের কথা বললাম, সেই তিনটি চেতনাই তো এখন আঘাতপ্রাপ্ত। তিনটিই প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে। জাতি হিসেবে এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় পর্যায়ক্রমে অবক্ষয় ঘটছে। কাগজে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের খবর পড়লে মনে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে ভাবি, এ কী সমাজ আমরা তৈরি করলাম? সম্প্রতি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কলঙ্কের কথা সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রতিষ্ঠান এভাবে ভেঙে পড়তে থাকলে, সমাজে পচনশীলতা বাড়তে থাকলে তো রাষ্ট্র ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। এখান থেকে রাষ্ট্রকে কীভাবে উদ্ধার করা সম্ভব বলা কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটা বড় মাইলফলক। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমদও ছিলেন। বাংলার ইতিহাসে সিরাজউদ্দৌলা যেমন ছিলেন, আবার মীর জাফরও ছিলেন। গৌরবের পাশাপাশি এই বৈপরীত্য সব সময় ছিল। কথা হলো, কোন পক্ষটাকে আমরা শক্তিশালী করব, সেটা এখন অনেক অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।
সুবর্ণজয়ন্তীর পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখে ভবিষ্যতে কোনদিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের রাজনীতি পথহারা হয়ে গেছে। শুধু রাজনীতির ভেতর থেকে এখন একে উদ্ধার করা কঠিন হবে। আমাদের যে নতুন উচ্চমধ্যবিত্ত, সেটা গড়ে উঠেছে শুধু টাকার জোরে, জ্ঞানগরিমার শক্তিতে নয়। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগরেরা গড়ে উঠছে না, গড়ে উঠছে উমিচাঁদরা। এগুলো প্রত্যক্ষ করা দরকার। একে বদলাতে হলে আমাদের শিক্ষার একটা আমূল পরিবর্তন দরকার। শিক্ষা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। মানুষের মন উন্মীলিত করার জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সময় বুদ্ধিজীবীরা বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। সে রকম একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা খুব জরুরি। শিক্ষিত সমাজ এবং চরিত্রবান মানুষদের নিয়ে সবাই মিলে একটা রেনেসাঁ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।