>
গত ২৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক হয়। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের চারজন বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
আলোচনা
মতিউর রহমান: প্রথম আলো গত ৪ নভেম্বর ১৮ বছর পূর্ণ করেছে। শুরু থেকেই প্রথম আলো কতগুলো নীতি নিয়ে চলছে। তার মধ্যে দলনিরপেক্ষতা হলো প্রধান। কিন্তু আমাদের দেশে তো এখন রাজনীতি আর সমাজ সবকিছুই বিভক্ত।
এর মধ্যেই রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা—এসব নিয়ে তো সব সময়ই আমাদের কিছু লিখতে হয়। এ ছাড়া কিছু কিছু বিষয় আসে, যার ওপর হয়তো আমরা বিশেষ নজর দিই। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনই একটা বিষয়। এই কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করার কোনো মনোভাব, চিন্তা আমাদের নেই। আমরা জানি যে ষাটের দশক থেকে এটার কার্যক্রম শুরু হয়। এখন এসে তা বেগবান হয়েছে। আমরা চাই, এটা বাস্তবায়িত হোক। কারণ, আমাদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আমাদের জ্বালানি শক্তির উন্নয়ন প্রয়োজন।
রূপপুরের ব্যাপারে আমরা একটা জিনিস বুঝেছি যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রথম শর্তই হলো দেশের নিজস্ব দক্ষ জনশক্তি। ইদানীং আমরা খবর পাচ্ছি যে জনশক্তি তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। কিছু লোক রাশিয়া ও ভারতে পাঠানো হচ্ছে।
চুক্তি করার পরে আমরা আরেকটি বিষয় দেখছি, পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেওয়া না–নেওয়া নিয়ে বিতর্ক। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব আলোচনার উদ্দেশ্য দেশবাসীকে সচেতন করা আর সরকারের কাছে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরা।
আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ কাইউম রূপপুর প্রকল্পের প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ ধারণা দেবেন।
এম এ কাইউম: রূপপুরে যে ধরনের রিঅ্যাক্টর বসানো হবে গত জুলাই মাসে রাশিয়ায় তেমনই একটি রিঅ্যাক্টর চালু হয়েছে, নভোভরোনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আমি সেটি পরিদর্শন করেছি। এই রিঅ্যাক্টরের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ১. একটি শক্তিশালী আবরণের মধ্যে রিঅ্যাক্টর ভবনটি আবৃত থাকে, যাতে কোনো দুর্ঘটনা হলেও ওই আবরণের বাইরে তেজস্ক্রিয়তা যেতে না পারে। শুরু থেকেই আমেরিকান রিঅ্যাক্টরে এই ব্যবস্থা ছিল। রাশিয়ার রিঅ্যাক্টরে ছিল না। ২. রিঅ্যাক্টরের নিচে ‘কোর ক্যাচার’ নামে একটি পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে, যাতে দুর্ঘটনায় রিঅ্যাক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হলে এমনকি ‘কোর মেল্টডাউন’ হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই গলিত বস্তু ওই কোর ক্যাচারের মধ্যে চলে যাবে। ফলে সেখান থেকেও কোনো তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারবে না। প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় পার্থক্য হলো, প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলেই সেখানে তাপ উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্ধ করার পরও দীর্ঘদিন ধরে তাপ উৎপন্ন হতে থাকে ‘বিকজ অব ডিকে হিট’। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার পরও রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা করার ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়। জাপানের ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার কারণ ছিল এই ডিকে হিট অর্থাৎ পারমাণবিক জ্বালানির তেজস্ক্রিয়তার কারণে সৃষ্ট তাপ। রূপপুরে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে ঠান্ডা করার দুই ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একটি প্রাকৃতিক, অন্যটি যান্ত্রিক।
মতিউর রহমান: বোঝা গেল, বর্তমান প্রযুক্তি আগের চেয়ে অনেক উন্নত। তাই তো? এখন আবদুল মতিন একটা প্রাথমিক বক্তব্য দেবেন।
আবদুল মতিন: মতিউর রহমান সাহেব শুরুতে যে জনবলের কথা উল্লেখ করলেন, সে বিষয়ে আমরা ২০০৯ সাল থেকে বলে আসছি। আমরা জনবলের বিষয়ে বিশেষ জোর দিলেও সরকার সেটা উপলব্ধি করতে পারেনি।
জনবল বলতে আমরা কী বোঝাই, সেটা বোঝা দরকার। জনবল মানে রিঅ্যাক্টর অপারেটর নয়। অনেকে মনে করেন যে এখন তো আমরা প্রশিক্ষণে পাঠাচ্ছি। তার মধ্য দিয়ে জনবল তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এটাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জনবল নয়। আইএইএর গাইড বইয়ে আছে, আমরা যে সময় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চাই তার অন্তত ১০ বছর আগে আমাকে জনবল তৈরি করতে হবে। এই জনবল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো নেবে। এই সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা কিন্তু আর শোধরানোর সুযোগ নেই। আইএইএর গাইড বই অনুসারে, যঁারা এ সিদ্ধান্ত নেবেন তঁাদের মধ্যে এমন কয়েকজন থাকতে হবে, পরমাণু প্রযুক্তি সম্পর্কে যঁাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা চুল্লি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের সমপর্যায়ের। যেহেতু জনবলের এই বিষয়টা আমরা বুঝিনি, সেহেতু আমাদের অনেক খেসারত দেওয়ার আশঙ্কা আছে।
দ্বিতীয় বিষয় যেটা নিয়ে আমি কথা বলছি তা হলো ব্যয়। মোট ব্যয় কত হওয়া উচিত এবং কত হয়েছে। মোট ২৪০০ মেগাওয়াটের দুই ইউনিটের জন্য সই করা চুক্তিতে আমাদের ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। এর বাইরে আমরা ইতিমধ্যে ৫৫০ মিলিয়ন (৫৫ কোটি) ডলার ব্যয় করে ফেলেছি। এটা যুক্ত করলে হবে ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার। এ থেকে যদি আমরা প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের জন্য ব্যয় হিসাব করি, তাহলে রূপপুর কেন্দ্রের জন্য তা দাঁড়ায় সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার।
এর সঙ্গে তুলনা করা যায় আমাদের এই অঞ্চলে রাশিয়ার তৈরি যেসব রিঅ্যাক্টর আছে সেগুলোর। এ রকম একটি ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই কেন্দ্রের ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০০২ সালে। এই দুটি ইউনিটের প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের জন্য ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৩০০ ডলার। এটা অনেক আগের কথা। এরপর ওই একই কেন্দ্রে ৩ ও ৪ নম্বর ইউনিটের কাজ সম্প্রতি শুরু করা হয়েছে। সেখানে প্রতি কিলোওয়াটের জন্য ব্যয় পড়ছে তিন হাজার ডলার। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ কোনো কর্ণপাত করেনি। সেটা হচ্ছে ‘থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি’। পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে। এখন যে প্রটোকল আছে, জয়েন্ট প্রটোকল সে অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে স্বত্বাধিকারী দায় তার, দোষ-ত্রুটি যারই হোক না কেন। আমরা এই প্রটোকলে আছি।
কিন্তু ভারত ২০১০ সালে একটি আইন পাস করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি সরবরাহকারীর কোনো যন্ত্রপাতির নিম্নমান বা অন্য কোনো ত্রুটি দুর্ঘটনার কারণ হয় তাহলে তার দায় সরবরাহকারীকেও নিতে হবে। রাশিয়া কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই আইন মেনেই চুক্তি সই করেছে। এ কারণেও তারা ব্যয় কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা খরচ যুক্ত করেও কুদনকুলম ৩ ও ৪ নম্বর ইউনিটে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের জন্য ব্যয় হচ্ছে তিন হাজার ডলার। এই হিসাব অনুযায়ী, রূপপুরের ব্যয় প্রতি কিলোওয়াটে চার হাজার ডলারের বেশি হতে পারে না। সেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার কেন হলো সেটা আমি বুঝতে পারছি না।
এরপর আসি সেফটির বিষয়ে। যখনই কোনো কারণে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে তখনই আমরা বলি, ওই কারণটি তো আমাদের জানা ছিল না। তাই এখনো যে আমাদের কাছে অজানা জিনিস নেই, সেই নিশ্চয়তা কি আমরা দিতে পারি? এ ক্ষেত্রে রেগুলেটরি বোর্ডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেই দায়িত্ব পালন করার মতো লোক আমাদের আছে কি না।
কুদনকুলমে নির্মাণ ঠিকাদারেরা চারটি সাব স্ট্যান্ডার্ড পাম্প স্থাপন করেছিল। সেটা ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ বোর্ড চিহ্নিত করেছিল। সেই পাম্পগুলো সরিয়ে নিয়ে রাশিয়া নতুন পাম্প পুনঃস্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। এ ধরনের বিষয় চিহ্নিত করার মতো দক্ষ লোকজন কি আমাদের আছে? যদি না থাকে তাহলে আমাদের উচিত ছিল একটা ‘ইনডিপেনডেন্ট কনসালট্যান্ট’ নিয়োগ করা, যারা আমাদের স্বার্থ সুরক্ষা করবে। কিন্তু তা না করে আমরা কনসালট্যান্ট নিয়োগ করেছি এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে, যেটি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী কোম্পানিরই একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তারা কার স্বার্থ রক্ষা করবে? আমাদের না চুল্লি সরবরাহকারীর?
আমাদের রেগুলেটরি বডি সাইট লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। এটা কি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে? নাকি সরকার বলেছে তোমরা সাইট লাইসেন্স দাও, দিয়ে দিয়েছে।
সেফটি কমিটির চেয়ারম্যান, সদস্য কারা হবেন অর্থাৎ তাঁদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কী হবে আইএইএর গাইড বইয়ে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। আমরা প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের শীর্ষস্থানে সেই অনুসারে লোক নিয়োগ করেছি কি? যদি না করে থাকি, তাহলে তাদের ভুলভ্রান্তির জন্য কারা দায়ী হবেন?
রূপপুরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আপনারা প্রশ্ন তুলেছেন। এটা খুবই যৌক্তিক। আমাদের সব সময়ই আশ্বস্ত করা হয়েছে যে স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়া নিয়ে যাবে। স্পেন্ট ফুয়েল হলো একটা জিনিস আর পারমাণবিক বর্জ্য হলো আরেকটা জিনিস। যেকোনো দেশকে (যাদের প্রযুক্তি আছে) টাকা দিলে তারা স্পেন্ট ফুয়েল নিয়ে রিসাইকেল করে বর্জ্য ফেরত দেয়। যেসব দেশ স্পেন্ট ফুয়েল রিসাইকেল করে সাধারণত তারা কেউই বর্জ্য রাখে না। কাজেই এই িবষয়টির এখনই সুরাহা হওয়া দরকার।
মতিউর রহমান: এটা নিয়ে আমাদের কাগজে নিউজ করা হয়েছে। সর্বশেষ কী হলো, আমাদের সাংবাদিক অরুণ কর্মকার বলবেন।
অরুণ কর্মকার: সর্বশেষ এ ব্যাপারে কিছুই হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এ ব্যাপারে আগামী ফেব্রুয়ারিতে আলাদা একটা চুক্তি হবে। সেখানে বিষয়টির সুরাহা হবে। এখন এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। এখন তৈরি করা হচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল ক্যালেন্ডার।
আবদুল মতিন: রূপপুরের পারমাণবিক বর্জ্য রাশিয়ার নিতে হলে তাদের সংসদে আইন সংশোধন করতে হবে। সেটা তারা করবে কি না আমি জানি না আর না নিলে এটা রাখা বাংলাদেশের জন্য দুরূহ হবে।
মতিউর রহমান: মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম এখন বলবেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও স্থাপনায় ৩০ বছরের বেশি কাজ করে অবসর নিয়েছেন। কর্মজীবনের শেষ ১৫ বছর তিনি কাজ করেছেন হ্যানফোর্ড রিজার্ভেশনে, নিউক্লিয়ার সেফটি ম্যানেজার হিসেবে। হ্যানফোর্ড থেকে যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা হয়েছিল সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নাগাসাকিতে ফেলা হয়েছিল।
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম: আমি কর্মজীবনের শেষ ১৫ বছর নিউক্লিয়ার সেফটি ম্যানেজার হিসেবে যে কাজ করেছি, তা ছিল পারমাণবিক বর্জ্যের ওপরে। এতক্ষণ স্পেন্ট ফুয়েলজাত বর্জ্য সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া দুই রকমের পারমাণবিক বর্জ্য হয়। কঠিন ও তরল। কঠিন বর্জ্যটা খুব বেশি বিপজ্জনক নয়। কারণ, সেগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়।
১৯৯৭ সালের ২৫ এপ্রিল আমি প্রধানমন্ত্রীকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাতে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা দরকার বলে আমি উল্লেখ করেছিলাম। এর দীর্ঘদিন পর, এখন থেকে বছর চারেক আগে পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে আমাকে টেলিফোন করে বলা হয়, পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে আমার ওই চিঠিটা পাওয়া গেছে। তো একদিন আমি সেখানে গেলে তাঁরা আলোচনা করবেন। আমি একদিন গেলাম পরমাণু শক্তি কমিশনে। কিন্তু আলোচনার জন্য কেউ বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখালেন না।
বছর দেড়েক আগে জামিলুর রেজা চৌধুরী সাহেব আমাকে একদিন ডাকলেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে একটা আলোচনার জন্য। তো তার আগে আমি রূপপুরে গেলাম। তো সেখান থেকে ফিরে আলোচনায় গিয়ে বললাম যে আমার কতগুলো কনসার্ন আছে। প্রধান কনসার্ন হলো পানি। আমি গিয়েছিলাম শীতকালের কোনো এক সময়। দেখলাম নদী প্রায় শুকনা। পানি নেই। তো এই অবস্থার কথা বলার পর পরমাণু শক্তি কমিশনের একজন কর্মকর্তা বললেন যে রাশিয়ানরা বলেছে যে ওই পানিই যথেষ্ট। কিন্তু আমি বললাম, না, আমি চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করেছি। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে রূপপুরে পানি যথেষ্ট নেই।
এর কিছুদিন পর পত্রিকায় পড়লাম যে রূপপুরে রাশিয়ানরা ‘কুলিং টাওয়ার’ করবে। তাতে কম পানিতেই চলবে। এ কথাটা সঠিক নয়। কুলিং টাওয়ার তো অপারেশনাল পিরিয়ডে রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা রাখবে। কিন্তু দুর্ঘটনার মতো কোনো জরুরি প্রয়োজনে পানি আসবে কোত্থেকে? এ জন্য তাহলে লেক করতে হবে। পদ্মা থেকে ১২ মাস প্রয়োজনীয় পানির নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না।
রূপপুরে আরও দেখলাম যে সমীক্ষার কাজ করছে রাশিয়ানরা। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে এদের কাজগুলো তত্ত্বাবধান করছে কারা? শুনলাম তাও করছে রাশিয়ানরা। ‘ফ্রম বিগিনিং টু এন্ড’ সবকিছু করছে রাশিয়ানরা। সব কিছু রাশিয়ানরা করলে পরমাণু শক্তি কমিশন কী করছে? সব দায়িত্বই কি তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়? এটা তো বেস্ট প্রসিডিওর নয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থানটা জনবহুল এলাকা থেকে দূরে হওয়া উচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ৪০ ফুট উঁচু জায়গা নির্ধারণ করতে পারলে ভালো হয়। চট্টগ্রাম, টেকনাফ, কক্সবাজার এলাকায় এ রকম জায়গা পাওয়া যেতে পারে। সেখানে সমুদ্র থেকে প্রচুর পানিও পাওয়া সম্ভব। রূপপুরের ক্ষেত্রে ধরুন যদি একটা দুর্ঘটনা হয় তাহলে তো পদ্মার ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছ দিয়ে সেই পানি সমুদ্র পর্যন্ত গড়াবে। তাতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত পুরো পানিপথ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেখানকার সব জলজ প্রাণী মরে যাবে। সমুদ্রের কাছে দুর্ঘটনা হলেও এত বড় ক্ষতি হবে না। সমুদ্রের সামান্য একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমার মত হচ্ছে এমন কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা উচিত নয়, যারা আমাদের পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেবে না।
একটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তিনটি জিনিস সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটা হচ্ছে প্লান্ট ইটসেলফ। একটা হলো জনবল, যারা এটা পরিচালনা করবে। আরেকটি হচ্ছে বেস্ট প্রসিডিউর।
এম এ কাইউম: জেনারেল কন্ট্রাক্টে কী আছে আমরা তা জানি না। আমাদের এই আলোচনাকে কেউ গুরুত্ব দেবেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে পরিমাণ স্পেন্ট ফুয়েলকেন্দ্রিক তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হবে, তা সামাল দেওয়া কোনোভাবেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
মতিউর রহমান: আপনারা এখানে আজ যে বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত আছেন তাঁরা যেভাবে বললেন যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়টি নিয়ে দেশবাসীকে জানানো, কনসার্নগুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা এবং সেগুলোর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, আমরাও এটাই চাই। আপনাদের মতোই আমরাও চাই একটি নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
আবদুল মতিন: কিন্তু বাস্তবে বিষয়গুলো এমন হয়েছে যে আমরা কথা বললেই সরকার থেকে বোঝানোর চেষ্টা হয় যে আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধী। এটা কিন্তু ঠিক অ্যাপ্রোচ না। এতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আড়ালে পড়ে যায়, যা হওয়া উচিত নয়। আমরা যে কথাগুলো বলছি, পরামর্শগুলো দিচ্ছি সেগুলো দেশের স্বার্থে, দেশের মঙ্গলের জন্য। আবার যে আমাদের বলায় একেবারে কোনো কাজ হয় না তা–ও বলা যায় না। কেননা ২০০৯ সালে পরমাণু শক্তি কমিশন যখন দ্বিতীয় প্রজন্মের রিঅ্যাক্টর আনার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছিল তখন আমি বলেছিলাম নো, ইউ শুড গো ফর থার্ড জেনারেশন রিঅ্যাক্টর। তারপর যখন আরও চার বছর চলে গেল কিছু না করে, তখন বলেছিলাম এখন অর্ডার দিয়ে রিঅ্যাক্টর তো ২০২৩-এর আগে পাওয়া যাবে না। তাই এখন আমাদের থ্রি প্লাস জেনারেশনের ভিভিইআর ১২০০ রিঅ্যাক্টরে যাওয়া উচিত। সেটা করা হয়েছে। ভারতে প্রশিক্ষণে পাঠানোর কথা আমিই প্রথম বলেছি।
মতিউর রহমান: এবার বলবেন রেজাউর রহমান। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
রেজাউর রহমান: রূপপুর আমাদের প্রায় ৫০ বছরের স্বপ্ন। এখন সেই প্রকল্প বাস্তবের মুখোমুখি। আমরা এগিয়ে গেছি। কিন্তু এত বিশাল প্রকল্পের যে ব্যয় তার ৯০ শতাংশই ঋণের টাকা। কাজেই আমাদের ঋণের দায় অনেক বাড়বে।
জনবলের কথা উঠলে বলা হয়, আমরা তো রাশিয়া ও ভারতে পাঠাচ্ছি। ঢাকা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগও খোলা হয়েছে। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যায়, এই জনবলে হবে না। প্রকৃতপক্ষে রিঅ্যাক্টর সম্পর্কে জানেন এমন লোকের অভাব এত সহজে পূরণ হবে না।
এরপরই আসে সেফটির বিষয়। এর দুর্বলতাগুলোর সুরাহাও হওয়া দরকার। বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে। না হলে তো পুরো ইকোসিস্টেমে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশনের (আইএইএ) ভূমিকা কী সে বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া উচিত।
বর্জ্য, দূষণ প্রভৃতি বিষয়কে আমরা সব সময় মানুষের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে দেখি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো হলো অ্যানিমেল ওয়ার্ল্ড, হোল লিভিং বডি এবং পুরো ইকোসিস্টেমের জন্য বিপর্যয়কর। মাটি, পানি সবকিছুর জন্য এটা ক্ষতিকর। এর ভয়াবহতা এমন হতে পারে যে তাতে ‘নিউ ইনডিভিজ্যুয়াল অব মাইক্রোবস’ তৈরি হতে পারে, যার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণই থাকবে না।
তাহলে নতুন রিঅ্যাক্টর তৈরি বা স্থাপন যেটাই বলি না কেন তা জীবনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের ছোট দেশ, গরিব দেশ। জনসংখ্যা অত্যধিক। তাই যত দূর সম্ভব কারেকশন ফ্যাক্টরগুলো নজরে রেখে সংশোধন করে আমরা যদি এগোতে পারি সেটা সুন্দর হবে। আমি আরও বলতে চাই যে এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা থেকে আমরা সহযোগিতা নিতে বা পেতে পারি কি না।
মতিউর রহমান: এই প্রশ্নটার একটা উত্তর খোঁজা দরকার। এমন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে কি না, যারা এটা দেখবে বা আমরা তাদের কাছে যাচ্ছি কি না।
আবদুল মতিন: এই প্রশ্নটা উঠেছিল ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর। আইএইএ ওই দুর্ঘটনার আগে জাপানকে সতর্কও করেছিল যে ওই রিঅ্যাক্টরগুলো চালু রাখা উচিত কি না। আইএইএ কেন শুধু সতর্ক করেই চুপ ছিল? কারণ হলো আইএইএর এ ধরনের ইন্টারফেয়ার করার মতো কোনো ম্যান্ডেট নেই। ম্যান্ডেট একটাই আছে। তা হলো পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা, যেটা তারা ইরানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছে। পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কোনো ম্যান্ডেট নেই।
মতিউর রহমান: ধন্যবাদ আবদুল মতিন। এখন এখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের যদি কোনো প্রশ্ন থাকে তা করতে পারেন। তারপর আমরা সমাপনীর দিকে যাব।
প্রশ্নোত্তর পর্ব
কামাল আহমেদ: আমি দুটি প্রশ্ন করতে চাই। এক. রাশিয়া ছাড়া অন্য কেউ কি আমাদের সাপ্লাই করত? কারণ অন্য যারা দিতে পারে, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে নানা ইকুয়েশন আছে। বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পথে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে আমরা নন-নিউক্লিয়ার হলে সমস্যা কী? আমাদের নিউক্লিয়ার হতে হবে কেন। যত ঝুঁকির কথা বলা হলো, যত আর্থিক দায়ের কথা বলা হলো, তারপরও আমরা কেন যাব। ইউরোপের অনেক দেশ তো নিউক্লিয়ার থেকে চোখ ফিরিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যাচ্ছে।
আবদুল মতিন: রাশিয়া আমাদের বন্ধুদেশ, এটা সত্য কথা। তারপরও একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। এই রাশিয়া ভারতকে প্রতি কিলোওয়াট তিন হাজার ডলার দরে দেবে। সেটা আমাদের কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার কেন নেবে?
এরপর কেন আমরা পারমাণবিক বিদ্যুতে যাব, যেটা বলেছেন এটা ভেরি ভ্যালিড প্রশ্ন। নবায়নযোগ্য শক্তির বিকল্প নেই। তবে নবায়নযোগ্য শক্তি বাণিজ্যিকভাবে ও ব্যাপক ভিত্তিতে তৈরি করতে আরও সময় লাগবে। তাই বর্তমান পর্যায়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎও দরকার আছে। সব বিকল্পই ব্যবহার করা প্রয়োজন।
সাজ্জাদ শরিফ: আমার প্রশ্ন হলো, আমরা বিপুল অর্থ ব্যয় করে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন করি। এর লাইফ যখন শেষ হয়ে যাবে তখন তা ডি-কমিশনিং করতে তো আরও বেশি ব্যয় এবং ঝুঁকি আছে। এ ব্যাপারে কি আমরা কিছু ভেবেছি?
আবদুল মতিন: রূপপুরের জন্য ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ডি-কমিশনিংয়ের ব্যয় ধরা হয়নি। সরকার করবে কী, যখন বিদ্যুৎ বিক্রি করবে তখন প্রতি কিলোওয়াটের দামের সঙ্গে একটা বাড়তি অর্থ যোগ করবে। ওই অর্থ আলাদা একটা তহবিলে জমা রাখা হবে। রিঅ্যাক্টরের লাইফ শেষ হয়ে গেলে ওই অর্থ ব্যয় করা হবে ডি-কমিশনিংয়ের জন্য। ডি-কমিশনিং ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
কামরুল হাসান: রূপপুর প্রকল্প তো সরকার করবেই। তবে আমার প্রশ্ন হলো এখন রূপপুরের আশপাশেই জনবহুল এলাকা। এই প্রকল্প হলে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ আছে কি না।
আবদুল মতিন: সে আতঙ্কটা আমারও আছে। দুর্ঘটনা হলে তখন যে সমস্যাটা কত ভয়াবহ হবে তা নিয়ে আমরাও চিন্তিত। যদি দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে ৩০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত সব মানুষ সরাতে হবে, যার সংখ্যা এখন প্রায় ৩০ লাখ। ২০ বর্গকিলোমিটার ধরলে প্রায় ১৫ লাখ। এদের কিন্তু সরাতে হবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। শুধু সরানোই নয়, তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা এমন নয় যে ঝড় এসেছে। মানুষজন সরিয়ে নেওয়া হলো। কয়েক ঘণ্টা পরে বা পরদিন আবার তারা নিজেদের জায়গায় ফিরে আসবে। তা নয়। প্রিলিমিনারি সেফটি অ্যানালাইসিস রিপোর্টে (পিএসএআর) এ ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। সেই পরিকল্পনা কি আছে? সরকার বলছে দুর্ঘটনা হবে না, তাতে কি আপনারা আশ্বস্ত হবেন?
রাজীব হাসান: আইএইএর যে রিকমান্ডেশন আছে, সম্ভবত ১০টা না ১১টা আপনি বলছিলেন, তার কোনোটাই বাংলাদেশ মেনে কাজ করেনি। এতে গত তিন-চার বছরে কোনো পরিবর্তন দেখছেন কি না। আরেকটি প্রশ্ন হলো, রূপপুরের জন্য যে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ব্যয় ধরা হচ্ছে, এই অর্থ দিয়ে কী পরিমাণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি পাওয়া সম্ভব?
এম এ কাইউম: নবায়নযোগ্য শক্তির এনার্জি ডেনসিটি অনেক কম। যেমন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রূপপুরের যতটা জায়গা ব্যবহার করা হবে, ততটা জায়গায় সৌরবিদ্যুৎ করলে মাত্র আট মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এখন ভাবুন যে ২৪০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ করতে কী পরিমাণ জায়গার দরকার। টাকার কথা ভুলে যান। আগে জায়গার কথা ভাবুন, যা ছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি করতে পারবেন না।
মশিউল আলম: পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রশ্নটি আলোচনায় অমীমাংসিত রয়ে গেল। আপনারা বলছেন রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল নেবে, বর্জ্য নেবে না। যদি তা-ই হয় তাহলে আমরা কি বর্জ্য সামলাতে পারব?
আবদুল মতিন: স্পেন্ট ফুয়েল রিসাইকেল করার পর প্রায় ৩ শতাংশ বর্জ্য পাওয়া যায়। পরিমাণে এটা কম হলেও এটা অত্যন্ত উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য। এটা সিলিকার সঙ্গে মিশিয়ে গলিত কাচের মতো একটা পদার্থ বানিয়ে তা স্টেইনলেস স্টিলের কনটেইনারে ভরে কংক্রিট দিয়ে শিল্ডিং করে কোনো নির্জন ও শুকনা স্থানে রাখা হয়। এই স্থানটা হতে হয় এমন যেখানে হয়তো এক লাখ বছরেও পানি আসেনি। এটা মেইনলি করা হয় পরিত্যক্ত লবণখনিতে। এ ধরনের কোনো স্থান বাংলাদেশে নেই। এ ছাড়া হতে পারে আমরা একটা হেভি কংক্রিটের স্ট্রাকচার তৈরি করে একটা জনমানবশূন্য নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা হবে ঝুঁকিপূর্ণ ও বহুল ব্যয়সাপেক্ষ।
সেলিম খান: শোনা যায় আইএইএ বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য জায়গা খুঁজছে। এটা কতটা ঠিক। আর রূপপুরে প্রতিবছর কী পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হবে?
আবদুল মতিন: আইএইএ এ রকম অনেক চিন্তাভাবনা করে। কিন্তু কোনো দেশ রাজি হবে না তার দেশে বর্জ্য রাখতে। টাকা দিলেও না। আর বর্জ্যের পরিমাণটা বিষয় নয়। একটা রিঅ্যাক্টরে এটা বছরে তিন কিউবিক মিটার হতে পারে। কিন্তু এর যে তেজস্ক্রিয়তা সেটা ভয়াবহ।
মুনির হাসান: আমার একটা খুব ছোট প্রশ্ন। আমরা তো ট্র্যাডিশনাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ম্যানেজ করছি অনেক দিন ধরে। এ রকম অনেক লোক অনেক দিন ধরে আমরা তৈরি করছি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ ধরনের লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যাবে না?
আবদুল মতিন: এই পরামর্শই তো আমি দিয়েছিলাম। ২০০৯ সালে আমি এটাই বলেছিলাম। শুধু বিদ্যুৎ নয়, সার কারখানার
মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স থেকেও জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীদের নিয়োগ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের কোনো নিয়োগ হয়নি।
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম: এখন যঁারা পামাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন, সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, তাঁদের এই বিষয়ে কী যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সেগুলো জনসমক্ষে আসা দরকার।
শিবব্রত বর্মন: তেজস্ক্রিয় বর্জ্যটা আসলে আমরা কাউকে দিতে পারব না। কেউ নেবে না। এটা আমাদেরই ম্যানেজ করতে হবে। এ জন্য আমাদের আরেকটা প্রকল্প করতে হবে কি না বিদেশিদের সহায়তায়।
আবদুল মতিন: এটা রাশিয়া ছাড়া আর কেউ রাজি হবে না। যারা পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ করবে, তাদের সঙ্গেই এ ব্যাপারে চুক্তি করতে হবে।
মতিউর রহমান: অরুণ কর্মকার সাংবাদিকতার সূত্রে অনেক দিন ধরে বিষয়টি দেখছে, সে বলুক।
অরুণ কর্মকার: আলোচনায় যে বিষয়গুলো এসেছে তার সবগুলো নিয়েই আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন করেছি, ছেপেছি। এর বাইরে একটা বিষয় আমি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখি। সেটা হচ্ছে জেনারেল কন্ট্রাক্টে ‘নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি’ বলে একটা ক্লজ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের কাজে দেশে এবং দেশের বাইরে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা, ড্যামেজ হলে তার দায় এককভাবে বাংলাদেশের। অর্থাৎ রাশিয়ায় যন্ত্রপাতি তৈরির সময়ও যদি কোনো ড্যামেজ হয় সে দায়ও বাংলাদেশকে নিতে হবে। অথচ প্রকল্পের ‘এ টু জেড’ করছে রাশিয়া। এই যে তারা কী করছে, কীভাবে করছে সেটা আমরা তত্ত্বাবধানও করছি না বা করার সামর্থ্যও আমাদের নেই। সুতরাং এই দায় আমরা কেন নেব, কীভাবেই বা নেব। আলোচনায় ড. মতিন বলেছেন, ভারত একটা আইন করে এই দায় রাশিয়ার অর্থাৎ সরবরাহকারীর ওপরও চাপিয়েছে। আমরাও সে রকম কোনো আইন করতে পারি কি না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
মতিউর রহমান: আমরা আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমাদের এই আলোচনা জনগণের জন্য, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের জন্যও। এখন আমাদের চারজন অতিথি আলোচক সংক্ষেপে তাঁদের মতামত বলবেন।
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম: আমি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে। আমি রূপপুরেরও পক্ষে। কিন্তু প্রকল্পটা করার সব দায়িত্ব শুধু সরবরাহকারীর ওপর দিয়ে দেওয়াটা আমি সমর্থন করতে পারি না। একটা ইনডিপেনডেন্ট বডি দরকার, যারা এদের ওপরে থাকবে এবং সবগুলো বিষয় তত্ত্বাবধান করবে। এ ছাড়া প্রকল্পের জায়গা হিসেবে রূপপুর সম্পর্কে, পানির প্রাপ্যতা সম্পর্কে এবং পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমার কনসার্ন আছে।
রেজাউর রহমান: রাশিয়ার কাজের তদারকি কে করবে, সেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতের সেই সক্ষমতা আছে। তাই তারা রাশিয়ানদের ভুল ধরতে পেরেছে। আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। তাই তত্ত্বাবধান করতে সক্ষম কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমাদের নিয়োগ করা উচিত।
এম এ কাইউম: পারমাণবিক বর্জ্য রাশিয়া নেবে কি না, এ বিষয়ের সুরাহা দ্রুতই হওয়া দরকার আর জনবল তৈরির কাজ যেভাবে এগোচ্ছে তা সন্তোষজনক নয়।
আবদুল মতিন: আমরা আলোচনা করছি নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে। আমরা চাই একটি নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ বিষয়ে স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে। পরমাণু শক্তির ভালো–মন্দ দুই দিকই আছে। জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। আমরা সেই কাজই করার চেষ্টা করছি, যেন জনগণ এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারে।
মতিউর রহমান: আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করছি।
যাঁরা অংশ নিলেন
এম এ কাইউম : সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
আবদুল মতিন : সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। সাবেক অধ্যাপক, ড. রশিদ চেয়ার, বুয়েট।
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম : যুক্তরাষ্ট্রের চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করে অবসর নিয়েছেন।
রেজাউর রহমান : সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা
সঞ্চালক
মতিউর রহমান : সম্পাদক, প্রথম আলো