ঘটনাটি তিন বছর আগের (২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি)। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সাবেক সদস্য মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে জান্নাতুল ফেরদৌস (১৬) নামের এক কিশোরী। হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া এক ভুয়া চিকিৎসকের কারণে মারা যায় ওই কিশোরী। পুলিশের তদন্ত বলছে, একজন এসএসসি পাস ব্যক্তিকে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সে ব্যক্তিকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে দৃশ্যত খুন করা হয়েছে ওই কিশোরীকে।
তদন্তের পর পুলিশ খুনের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রিজেন্ট হাসপাতালের একজন ভুয়া চিকিৎসকসহ চারজনের নামে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। অথচ ওই খুনের মামলায় সাহেদকে আসামি করা হয়নি।
মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের ওই ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেন আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ‘১৯৯৫ সালে আমি এসএসসি পাস করি। এরপর আর পড়ালেখা করিনি। আমি ১৯৯১ সালে পল্লি চিকিৎসকের একটি কোর্স করি। ১৯৯৫ সালে আমি ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় ওষুধের ব্যবসা করতে করতে ডাক্তারদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের কাজে সহায়তা করতে করতে কাজের অভিজ্ঞতা হয়। গত বছরের (২০১৬) ১৬ ডিসেম্বর আমি রিজেন্ট হাসপাতালে গিয়েছিলাম চাকরির জন্য। সেখানে এমডি ও মার্কেটিং এর খলিলুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। আমি বলি, আমি আইসিইউ ও ওটির কাজ জানি। পরে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ সাহেব আমাকে ডাকেন। তিনি আমাকে ওই হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ দেন। আমি ‘অন কলে’ চিকিৎসা করতাম। ঘটনার দিন বেলা তিনটায় রিজেন্ট হাসপাতালে যাই। অপারেশন থিয়েটারে জান্নাতুল ফেরদৌস শুয়ে ছিল। হাসপাতালের ডাক্তার নাসির উদ্দিন ওই রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া ইনজেকশন দিতে বলে। আমি ইনজেকশন দিই। পরে দেখি রোগীর শরীরে অক্সিজেন কমে গেছে। কিছুক্ষণ পর জান্নাতুল ফেরদৌস মারা যায়।’
ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেনকে রিজেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে উল্লেখ থাকলেও কেন সাহেদকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করা হয়নি? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. কবির হোসেন বলেন, ‘জান্নাতুল ফেরদৌস খুনের মামলায় আমি সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। কিন্তু ভুয়া চিকিৎসক ফারুকের নিয়োগপত্র পেলে আমি সাহেদকে এই খুনের মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করতাম।’
আসামি করা হয়নি সাহেদকে
জান্নাতুল ফেরদৌসের বয়স যখন নয় বছর, তখন পড়ে গিয়ে সে বাঁ হাত ভেঙে ফেলে। তখন তাঁকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাঁ হাত সামান্য বাঁকা হয়ে যেতে থাকে।
জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা জয়নাল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর সাত বছর পর আমার মেয়ের বাঁ হাতে সমস্যা হওয়ায় রিজেন্ট হাসপাতালের সাইফুল নামের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলি। সাইফুল আমাকে বলেছিল, রিজেন্ট হাসপাতালে ভালো ডাক্তার আছে। আমার মেয়ের চিকিৎসা রিজেন্ট হাসপাতালে ভালো হবে। পরে আমি আমার মেয়েকে ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি। পরে ওই হাসপাতালের ভুয়া ডাক্তার ফারুক মেয়েকে দুটো ইনজেকশন দেয়। পরে আমার মেয়ে মারা যায়। আমি পল্লবী থানায় হত্যা মামলা করি।’
জান্নাতুল ফেরদৌস হত্যা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে পল্লবী থানার পুলিশ। থানার পুলিশই রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। ২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ফারুক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেই জবানবন্দিতে উঠে আসে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের নাম। তবে সাহেদকে কখনোই পুলিশ আটক করেনি।
থানা-পুলিশের হাত ঘুরে মামলার তদন্তভার পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির তদন্তেও উঠে আসে, জান্নাতুল ফেরদৌস খুন হন। তবে ডিবি পুলিশ রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজবাউল আলম ও রিজেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক নাসির উদ্দিন সিকদারকে মামলা থেকে বাদ দেন। ভুয়া চিকিৎসক ফারুক ও হাসপাতালের সহকারী সাইফুলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
ডিবির অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে নারাজি দেন জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা জয়নাল শেখ। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সঠিকভাবে তদন্ত করেনি। মামলার আসামি রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মেজবাউল ও চিকিৎসক নাসির উদ্দিন নানাভাবে আপস করার জন্য চাপ দেয়। আপস না করায় ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করে বাদীকে হত্যার হুমকিও দেয়। আমার মেয়েকে অপারেশন করার কথা বলে অপারেশন থিয়েটার নিয়ে ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল এই হত্যার দায় এড়াতে পারে না।’
জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবার আবেদন আদালত গ্রহণ করে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের তদন্তেও উঠে আসে, জান্নাতুল ফেরদৌসকে খুন করা হয়েছে। এই খুনের সঙ্গে জড়িত আছেন রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেন, চিকিৎসক নাসির উদ্দিন, এমডি মেজবাউল আলম এবং হাসপাতালের সহকারী সাইফুল।
পিবিআইয়ের অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত গত বছরের ২৪ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা জয়নাল শেখ বলেন, ‘জান্নাতুল আমার বড় মেয়ে। আমার মেয়েকে চিকিৎসার নামে রিজেন্ট হাসপাতাল হত্যা করেছে। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু সাহেদ আমার সঙ্গে দেখা করেনি। উল্টো আমার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিয়েছে।’
পিবিআইয়ের পরিদর্শক কবির হোসেন বলেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু জান্নাতুল ফেরদৌস হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিতে পারিনি, কারণ পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাইনি। যদি ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেনের নিয়োগপত্র পেতাম, তাহলে অবশ্যই আমি সাহেদকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করতাম।’
জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা জয়নাল শেখ বলেন, ‘আমার মেয়ের চিকিৎসার নাম করে রিজেন্ট হাসপাতাল আমার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছিল। সেই টাকা আমি ফেরত পাইনি। আমার মেয়েকে খুন করল। এখনো আমি বিচার পাইনি। আমি বিচার চাই। আমার মেয়ের হত্যার দায় সাহেদ কোনোভাবে এড়াতে পারে না। আমি সাহেদের বিচার চাই।’