১৬ নভেম্বর। বেলা সাড়ে তিনটা। বরিশাল নগরীর ভাটিখানা সড়ক দিয়ে মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার পথে একটি রিকশার পেছনে চোখে পড়ল—শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ছবি-সংবলিত একটি ব্যানার। এতে লেখা ‘নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে জাতির সহায়তায়। মহত্ত্ব নিয়ে অনাসক্ত হয়ে ব্যক্তিসত্তার স্বকীয়তা ভুলতে হবে, লুপ্ত করতে হবে’।
ওই রিকশার পেছনের অন্য রিকশার যাত্রীরাও ব্যানারটি মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। মনোযোগ আসারই কথা। কারণ, রিকশার পেছনে একসময় থাকত সিনেমার পোস্টার। সেখানে মহান ব্যক্তিদের বাণী আসায় সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন রিকশাওয়ালার দিকে। রিকশার পেছনে শেরেবাংলার বাণীর রহস্য খুঁজতে পিছু নিলাম। ভাটিখানা জোড় মসজিদ এলাকায় রিকশা থামিয়ে মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তুলতেই ভড়কে গেলেন রিকশাচালক। রিকশার যাত্রী সিট ছেড়ে নামতে নামতে বললেন, ‘ভাই যা করেন, অন্তত ছবি তুলে ওর ক্ষতি কইরেন না।’
রিকশার পেছনে হঠাৎ করে শের-ই-বাংলার বাণীর কারণ জিজ্ঞেস করতেই রিকশাচালক আবু বকর বললেন, ‘এটা তো আমি লাগাইনি।’ তাহলে কে, প্রশ্ন করতেই তাঁর জবাব—‘কে আবার, আমাদের মনীষাদি।’ শুধু আমার রিকশাই নয়, বরিশালের আড়াই শর বেশি রিকশায় এ ধরনের ব্যানার লাগানো আছে। সবার রিকশায় এ ধরনের বাণী লাগিয়ে দেওয়া হবে। নগরী ঘুরে অনেক রিকশার পেছনে পাওয়া গেল মনীষীদের বাণী-সংবলিত ব্যানার। শেরেবাংলা, কার্ল মার্ক্স, লেনিন, সক্রেটিস, চার্লি চ্যাপলিন, চে গুয়েভারা, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশসহ আরও অনেকের বাণী-সংবলিত ব্যানার চোখে পড়ল। বাণীগুলো এমন—
১. বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন বস্ত্র উপার্জন করুক—বেগম রোকেয়া
২. আইন মাকড়সার জালের মতো। ক্ষুদ্র কেউ পড়লে আটকে যায়, বড়রা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে—সক্রেটিস
৩. শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য আবশ্যক। ঐক্য কার্যকরী হয় একক সংগঠন মারফত, যার সিদ্ধান্ত সমস্ত সচেতন শ্রমিক পালন করে, ভয়ের তাড়নায় নয়, বিবেকের তাড়নায়—লেনিন
৪. বিজয়ের পথে আজীবন। হয় স্বদেশ নয় মৃত্যু, তুমি যদি প্রতিটি অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠো, তাহলেই তুমি আমার একজন সহযোদ্ধা—চে গুয়েভারা
৫. মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ—কাজী নজরুল ইসলাম
৬. বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর—জীবনানন্দ দাশ
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বরিশালে রিকশার পেছনে বিভিন্ন মনীষীর বাণী-সংবলিত ব্যানার লাগানোর কারিগর খেটে খাওয়া মানুষে প্রিয় নেত্রী ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সদস্যসচিব মনীষা চক্রবর্তী। গত ১৫ নভেম্বর থেকে বরিশাল রিকশা-ভ্যান চালক ইউনিয়নে মনীষীদের বাণী-সংবলিত ব্যানার লাগানো হয়।
রিকশার পেছনে মনীষীদের বাণী নিয়ে কথা হয় বাসদের সদস্যসচিব মনীষা চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নগরীতে সাত শ মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রয়েছে। এসব চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে নগরীতে চলাচলের অনুমতি এনেছি। প্রথমত, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের একটা পরিচিতি দরকার। পরিচিতির জন্য রিকশার পেছনে কী দেওয়া যায়—এই থেকেই মূলত এ ধরনের চিন্তা মাথায় আসে। রিকশা হচ্ছে প্রচলিত বাহন। এটি জনগণের সব সময় প্রয়োজন হয়। আমরা দেখি রিকশার পেছনে বিভিন্ন অর্থহীন পোস্টার থাকে। কোনো কোনোটিতে বিভিন্ন ছবি আঁকা থাকে, যার কোনো অর্থ নেই। ফলে আমরা অর্থবহ কিছু রিকশায় লাগানোর চিন্তা করলাম। যার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে। এ জন্য আমরা কয়েকজন মনীষীর বাণী বাছাই করেছি, যেগুলো শ্রমিকদের আন্দোলনের কথা বলে, দেশপ্রেমের কথা বলে, মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা বলে। বাণীগুলো শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে যেমন শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ঐক্যের জন্য সচেতনতার কথা আছে, তেমনি রিকশার যাত্রীদের জন্যও কিন্তু একটা ম্যাসেজ।’
সব রিকশাওয়ালা কি এ ধরনের বাণীর অর্থ বুঝবে—এমন প্রশ্নের জবাবে মনীষা বলেন, ‘সবাই হয়তো বুঝবে না। কিন্তু কারও কারও কাছে তো বিষয়টি বোধগম্য হবে। আমরা বলছি না যে, শতভাগ সফল হব। তবে অনেকটা সফলতা আসবে, এটা তো আশা করা যায়। তা ছাড়া ব্যানার-ফেস্টুন বিতরণের সময় আমরা প্রত্যেককেই মনীষীদের বাণী সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি।’
উদাহরণ দিয়ে মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের একজন সদস্যকে বেগম রোকেয়ার বাণী-সংবলিত ফেস্টুন দিলাম। এতে লেখা আছে—“বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন বস্ত্র উপার্জন করুক”। রিকশাওয়ালা ভাই আমার কছে জানতে চাইলেন, দিদি, এর অর্থ কী। আমি তাঁকে বোঝাতে লাগলাম। কথা শেষ না হতেই তিনি (রিকশাচালক) আমাকে থামিয়ে বললেন, “হয় বুজ্জি। মেয়েরে আগে বিয়ে না দিয়া লেহাপড়া কড়াইয়া মানুষ করতে অইবে।”’ মনীষা বলেন, ‘সমাজকে পাল্টাতে হলে আগে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এই সচেতনতার কাজ একদিনে হবে না।’
লেখক: জসিম জিয়া, বরিশাল