রাশিয়া থেকে অভিনব কায়দায় কার্ড জালিয়াতি শিখে আসেন শরিফুল ইসলাম (৩৩)। দেশে ফিরে এ কৌশল প্রয়োগ করে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। একটি নামকরা সুপার শপে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করার সময় ব্যবহার করতেন ডিজিটাল হাতঘড়ি, যাতে সংযুক্ত করা ছিল বিশেষ ‘মিনি কার্ডরিডার’। সেটা দিয়েই গ্রাহকের ক্রেডিট কার্ডের সব তথ্য নিতেন তিনি।
আজ বুধবার পাঁচটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি অভিযোগে শরিফুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর মালিবাগে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি এই কার্ড জালিয়াতির বিস্তারিত বর্ণনা করে। এতে বেরিয়ে আসে সুদীর্ঘ এক অপরাধের গল্প।
চলতি বছরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাঁচটি ব্যাংকের (ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইবিএল, ইউসিবিএল, ব্যাংক এশিয়া) কার্ড জালিয়াতির ঘটনা সিআইডির নজরে আসে। এরপর সিআইডি এটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে।
তদন্তে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। ব্যাংকের গ্রাহকেরা যখন বিভিন্ন সুপার শপ ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যান, তখন এই চক্রটি সুকৌশলে গ্রাহকের তথ্য চুরি ও ক্লোন কার্ড তৈরি করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলে।
শরিফুল ইসলাম এই চক্রের মূল হোতা। তিনি সুপার শপ স্বপ্নের বনানী শাখায় কাজ করতেন। নিজের হাতঘড়িতে সংযুক্ত বিশেষ মিনি কার্ডরিডারের মাধ্যমে গ্রাহকের কার্ডের অভ্যন্তরীণ তথ্য নিয়ে নিতেন। এরপর গ্রাহক যখন পিন নম্বর দিতেন, তখন সুকৌশলে পিন নম্বর দেখে রাখতেন। বিল পরিশোধ করে গ্রাহক চলে যাওয়ার পর ওই পিন নম্বর সংগ্রহ করতেন।
পরে বাসায় গিয়ে ল্যাপটপ ও ডিভাইসের মাধ্যমে গ্রাহকের তথ্য খালি কার্ডে স্থাপন করে ক্লোন এটিএম কার্ড বানিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিতেন। অসম্ভব কৌশলী শরিফুল এটিএম কার্ড থেকে টাকা তোলার সময় পরচুলা ও কালো চশমা ব্যবহার করতেন।
স্বপ্নে চাকরি করলেও শরিফুলের মূল পেশা ছিল ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি। মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত চলাচলের জন্য টয়োটা এলিয়ন মডেলের গাড়ি ব্যবহার করতেন তিনি। তাঁর ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শরিফুল জানান, তাঁর বাবার নাম ইয়াজউদ্দিন বিশ্বাস। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। এইচএসসি পাস করার পর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য রাশিয়া যান। সেখানে খনি প্রকৌশল বিষয়ের ওপর তিন বছরমেয়াদি ডিগ্রি নেওয়ার পর ২০১০ সালে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। রাশিয়ায় প্রকৌশল পড়ার সময় তাঁর রুমমেট ছিলেন ইভানোভিচ নামের এক ব্যক্তি। তিনি রাশিয়ার নাগরিক। ইভানোভিচের কাছ থেকে ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার কৌশল শেখেন শরিফুল। দেশে আসার পরপরই কার্ড জালিয়াতিতে নেমে পড়েন। ২০১৩ সালে এ-সংক্রান্ত দুটি মামলায় ১৮ মাসের জেলও খেটেছেন শরিফুল। এপর কিছুদিন শিক্ষার্থী কনসালটিং ফার্ম খোলেন। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে আবার জালিয়াতি শুরু করেন।
সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া সেল) শারমিন জাহান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শরিফুল বলেন, ‘আমাকে ধরলে আমার মতো আরও ১০০ জন জন্মাবে, যারা এ কাজ করতে পারে। যতক্ষণ না ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা বদলাবে, ততক্ষণ এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’
গ্রেপ্তারের সময় শরিফুলের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, ১ হাজার ৪০০ ক্লোন কার্ড, গ্রাহকদের তথ্য চুরিতে ব্যবহৃত সচল ডিজিটাল হাতঘড়ি, ১৪টি পাসপোর্ট, দুটি মিনি কার্ডরিডার ডিভাইস, একটি পরচুলা, একটি কালো রঙের সানগ্লাস ও আটটি মোবাইল ফোন জব্দ করে সিআইডি।