রানির দেশের লাইব্রেরি যেমন দেখলাম

গ্রন্থাগার সেবার ধরন, পরিকল্পনা, সহযোগী সংস্থার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নেটওয়ার্কিং, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ২০৩০ অর্জনে পদক্ষেপগুলো দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। ছবি: সংগৃহীত
গ্রন্থাগার সেবার ধরন, পরিকল্পনা, সহযোগী সংস্থার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নেটওয়ার্কিং, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ২০৩০ অর্জনে পদক্ষেপগুলো দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। ছবি: সংগৃহীত

হেমন্তের রোদহীন ফ্যাকাশে এক দুপুরে আমরা যুক্তরাজ্যের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই চোখে পড়ল ভীষণ পরিচিত ছাদের ওপর চিমনিওয়ালা পুরোনো ধাঁচের ও একই স্থাপত্য নকশার সারিবদ্ধ সব বাড়ি। বাড়িগুলোর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল এগুলো পুরোনো ধাঁচের স্থাপত্যে তৈরি। মজার তথ্য হলো, এসব এলাকায় নতুন বাড়ি তৈরি করা হলে এখনো নাকি এই একই ধাঁচেই করা হয়। ঐতিহ্য রক্ষা বলে কথা!

ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিজ আনলিমিটেডের আয়োজনে স্টাডি ট্যুর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য পাঁচ দিনের সফরে ১০ জন লাইব্রেরি পেশাজীবী যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিজ আনলিমিটেড আয়োজিত স্টাডি ট্যুর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য পাঁচ দিনের সফরে আমরা ১০ জন লাইব্রেরি পেশাজীবী যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলাম। সফরে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়ে আমি যারপরনাই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। সরকারি আদেশ, টিকিট, ফ্লাইটসহ অন্য সব কাগজপত্র ঠিক, কিন্তু আমার ভিসা প্রাপ্তির কোনো খবর নেই। ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসছে তবে ব্রিটিশ হাইকমিশনের কোনো বার্তা এখনো আসছে না! ততোধিক শঙ্কা নিয়ে আমি অপেক্ষার প্রহর গুনছি। অবশেষে, কাঙ্ক্ষিত সেই খুদে বার্তা এল এবং যথাসময়ে দলের সঙ্গে উড়াল দিলাম মহারানি ভিক্টোরিয়া ও রানি এলিজাবেথের দেশে। গ্রন্থাগার সেবার ধরন, পরিকল্পনা, সহযোগী সংস্থার সঙ্গে তাদের নেটওয়ার্কিং, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতি এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ২০৩০ অর্জনে তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো দেখাই ছিল আমাদের এ যাত্রার মূল উদ্দেশ্য।

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ লাইব্রেরি ব্রিটিশ লাইব্রেরিসহ কয়েকটি লাইব্রেরির কার্যক্রম ঘুরে দেখেছেন লেখিকা রেজিনা আখতার। ছবি: সংগৃহীত

ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অবস্থিত ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম ও ব্যস্ততম গ্রন্থাগার ‘লাইব্রেরি অব বার্মিংহাম’ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের শিক্ষাসফর এবং সভা কার্যক্রম শুরু হয়। পুরো কার্যক্রমে আমাদের করণীয় এবং সভার বিস্তারিত সম্পর্কে ধারণা দেন ‘চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রফেশনালস’–এর সাবেক প্রেসিডেন্ট আইউব খান এবং কনসালট্যান্ট জন ডোলেন। নান্দনিক এবং আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া বার্মিংহাম লাইব্রেরির নতুন এই ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালে। বিশিষ্ট স্থপতি ফ্রানসিন হিউবেনর ডিজাইনে গড়া আধুনিক এই গ্রন্থাগারে শিশু-কিশোর এবং বড়দের জন্য রয়েছে স্টাডি সেন্টার, মিউজিক লাইব্রেরি, কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, মাল্টিমিডিয়া আর্কাইভস, এক্সিবিশন হল, ক্যাফে লাউঞ্জ, ৩০০ আসনের অডিটরিয়াম এবং সিক্রেট গার্ডেন। বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের স্মরণে বার্মিংহাম লাইব্রেরিতে রয়েছে উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার মেমোরিয়াল হল।

অসম্ভব সুন্দর এবং আকর্ষণীয় এই গ্রন্থাগার সম্পর্কে আমাদের ব্রিফ করেন গ্রন্থাগারের কালচারাল ম্যানেজার টম অ্যাপস। বার্মিংহামবাসী যে শেক্‌সপিয়ারকে লালন এবং ধারণ করে, তা বুঝতে পারলাম তাঁর জন্মস্থান স্ট্রার্টফোর্ড-আপন-অ্যাভনে গিয়ে। ভিক্টোরিয়ান যুগের চিমনিওয়ালা লাগোয়া সব কাঠের বাড়ি। ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডে উপকণ্ঠের একটা গ্রামের মতো করে সাজানো আছে পুরো পরিবেশটা। শেক্‌সপিয়ারের ছেলেবেলা কেটেছিল যে বাড়িতে, সেটি এখন মিউজিয়াম। ঘরগুলোর সমস্ত আসবাবপত্র, যেমন: বিছানা, বালিশ, জামাকাপড় ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু ঠিক সেই সময়ের মতো করে সাজানো আছে। শেক্‌সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট লাইব্রেরিতে দুষ্প্রাপ্য অনেক বইয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু বাংলা বইও সংরক্ষণ করা হয়েছে দেখে খুব ভালো লেগেছে।

বার্মিংহাম শহরের লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ভাষাভাষীর পত্রিকা ও বাংলা বইয়ের একটি কর্নার। ছবি: সংগৃহীত

পরের গন্তব্য ওয়ার্ড অ্যান্ড লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিটি বার্মিংহাম শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে দক্ষিণ এশিয়ার লোকের বাস। বেশ পুরোনো এই লাইব্রেরি সম্প্রতি নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। আধুনিক এবং আকর্ষণীয় আসবাবপত্রে সাজানো এই লাইব্রেরি স্থানীয় মানুষদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম একটি স্থান হচ্ছে ওয়ার্ড অ্যান্ড লাইব্রেরি। কী সুন্দর ব্যবস্থা! শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্যই রয়েছে উপযোগী সব আয়োজন। যেহেতু এখানে বহু সংস্কৃতির লোকের বাস, তাই এই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ভাষাভাষীর পত্রিকাও দেখতে পেয়েছি। বাংলা বইয়ের একটি কর্নার দেখতে পেয়ে বেশ ভালো লেগেছিল। রঙিন ঝলমলে শিশু কর্নারটিতে আসবাবপত্র থেকে শুরু করে কম্পিউটারের কি-বোর্ড পর্যন্ত শিশুদের উপযোগী করে তৈরি করা। লাইব্রেরি ম্যানেজার সালিম আইয়ুব এবং তাঁর কর্মীরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই পুরো লাইব্রেরি এবং তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের বুঝিয়েছিলেন। এ ছাড়া স্ট্রার্টফোর্ড-আপন-অ্যাভন লাইব্রেরি এবং চেল্মসমফোর্ড লাইব্রেরিটিও অসাধারণ। দুটি লাইব্রেরি; যেখানে রয়েছে সব বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য আধুনিক সব ব্যবস্থা। শিশুরা তাদের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাতে লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। শিশু-কিশোরেরা যাতে প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিক গুণাবলিও অর্জন করতে পারে, সে জন্য এসটিইএমের পাশাপাশি রয়েছে এসটিইএম শিক্ষারও ব্যবস্থা। শিশু-কিশোরেরা মেকারস্পেস ব্যবহার করে নিজেদেরকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে গুণগতভাবে যুক্ত করে চলেছে।

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ লাইব্রেরি ব্রিটিশ লাইব্রেরির খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই লাইব্রেরি দেখার। এত বিশাল লাইব্রেরি এত স্বল্প সময়ে দেখা সম্ভব নয়; তারপরও যতটুকু সম্ভব দেখা যায় আরকি! সুন্দর এবং আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া বিশাল এই মূল লাইব্রেরি ভবন। লাইব্রেরি চত্বরে ঢোকার মুখেই দেখা গেল কালো ধাতু দিয়ে গড়া স্যার আইজাক নিউটনের বিশাল এক ভাস্কর্য। বড় একটি বেদির ওপরে কম্পাস হাতে এক বস্ত্রহীন পুরুষালি শরীরের প্রতীক মাথা নিচু করে বসে আছে গভীর কাজে মগ্ন হয়ে।

ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামে ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম ও ব্যস্ততম গ্রন্থাগার ‘লাইব্রেরি অব বার্মিংহাম’। কবি উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের স্মরণে বার্মিংহাম লাইব্রেরিতে রয়েছে উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার মেমোরিয়াল হল। ছবি: সংগৃহীত

এভাবেই শেষ হলো আমাদের সংক্ষিপ্ত সফর। দেশে ফিরলাম রানির দেশের অসাধারণ সব লাইব্রেরির সেবা ও কার্যক্রমের ছবি বুকে নিয়ে। দেখি, এখন আমার দেশে কী কী নতুন সেবা চালু করা যায় রানির দেশের আদলে। কিছু কিছু নকলে লজ্জা নেই বরং গর্ব আছে!

লেখক: লাইব্রেরিয়ান, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি