পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার আওতায় না আনতে পারলে সিলেটের জলাবনখ্যাত রাতারগুলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এ জন্য উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনগণকে নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা করতে হবে। এ পরামর্শ দিয়েছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগের শিক্ষকেরা।
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর এক দশকে রাতারগুলের অবস্থা কী হয়েছে, এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে বুধবার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পরিদর্শন করে এই পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শের আলোকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপাজেলা প্রশাসনের পর্যটন কমিটি রাতারগুলের ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করবে জানানো হয়।
গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুল জলাবন (সোয়াম্প ফরেস্ট) হওয়ায় ১৯৭৩ সালে সংরক্ষিত ঘোষণা করে বন বিভাগ। নদী ও হাওরবেষ্টিত ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের পুরো এলাকা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা অজানা ছিল। ২০১২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রাতারগুলের একটি আলোকচিত্র প্রকাশিত হলে তা নতুন করে পরিচিত করে তোলে এই নয়নাভিরাম স্থানকে।
রাতারগুল জলাবন হিসেবে মূল কর্তৃপক্ষ বন বিভাগ হলে পর্যটকদের আনাগোনার কারণে উপজেলা পর্যটন কমিটি রাতারগুলের সামগ্রিক বিষয়ে নজর রাখে উপজেলা প্রশাসন। মূলত বর্ষকালই রাতারগুলের যৌবন। বেড়াতে যাওয়া মানুষ নৌকায় করে বনে ঘুরে বেড়ান। সম্প্রতি পর্যটকদের কাছ থেকে একটি নির্ধারিত ফি রাখছে বন বিভাগ। পর্যটকদের সুবিধা ও রাতারগুলের পর্যটকবান্ধব ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সরেজমিন অনুসন্ধান করতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসন বনভূমিজুড়ে ছড়ানো-ছিটানো প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্রভাবে ফেলে রাখা দেখতে পায়। একদল শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে গত ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসে প্লাস্টিক বর্জ্য আটটি নৌকা দিয়ে অপসারণ করা হয়। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনার কী হতে পারে, বিশেষজ্ঞ মতামত সংগ্রহ করতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে উপজেলা পর্যটন কমিটির উদ্যোগে রাতারগুল পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পরিদর্শক দল রাতারগুল পরিদর্শন করে। তাদের সঙ্গে উপজেলা পর্যটন কমিটির সভাপতি হিসেবে গোয়াইনঘাটের ইউএনও তাহমিলুর রহমানও ছিলেন। রাতারগুলের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে বনের ভেতরকার চিত্র টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করেন তাঁরা। এই পর্যবেক্ষণে রাতারগুলে আরও বনায়ন, বর্ষকাল ছাড়া শুষ্ককালে পানি আবদ্ধ করে না রাখার পক্ষে মতামত দেন। পাশাপাশি বনের প্রাণী সুরক্ষায় একাধিক স্থানকে ‘নীরব অঞ্চল’ ঘোষণার প্রস্তাব দিয়ে বনে একটিই প্রবেশপথ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
এসব পরামর্শ একটি পরিকল্পনার মধ্যে এনে বাস্তবায়ন করতে রাতারগুল ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনায় একটি ‘মহাপরিকল্পনা’ প্রয়োজন বলে মনে করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি কৌশিক সাহা। তিনি বলেন, ‘আমরা যা দেখলাম, তা হলো একটি বিখ্যাত বন অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়ে আছে। নানামুখী সমস্যা আছে। মহাপরিকল্পনার আওতায় না আনা হলে এটিকে রক্ষা করা মোটেও সম্ভব নয়। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ নিয়ে গবেষণা করে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে পর্যটন কমিটির কাছে দেব। কাজটি তিন মাসের মধ্যে করার ইচ্ছা আছে আমাদের। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট তিনটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতামতও থাকবে।’
‘মহাপরিকল্পনা’ তৈরি হলে ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনার আলোকেই পরিচালিত করতে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ও বিদেশে বনটির পরিচিতি ২০১২ সাল থেকে। আগামী বছর এক দশক পূর্ণ হবে। এক দশকে কী পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের চোখে তা দেখতেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে এই পরিদর্শন। তাঁদের প্রস্তাব করা ‘মহাপরিকল্পনা’ পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।