রাতারগুল কতল হবে?

সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল বনের ভেতরের এই পথকে ১৫ ফুট চওড়া ইটের রাস্তা করা হবে। কাটা পড়বে অনেক গাছ। বনের ভেতরে হচ্ছে ভবন । ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল বনের ভেতরের এই পথকে ১৫ ফুট চওড়া ইটের রাস্তা  করা হবে। কাটা পড়বে অনেক গাছ। বনের ভেতরে হচ্ছে ভবন । ছবি: আনিস মাহমুদ

জল আর বনের মিতালি। তাই তো এটি জলার বন। দাপ্তরিক নাম রাতারগুল। নৈঃশব্দ্য সৌন্দর্যের এই বন দ্রুত দৃষ্টি কাড়ে পর্যটকদের। সেই সঙ্গে বুঝি ‘প্রকল্পবাজদেরও’। প্রশ্ন উঠেছে, রাতারগুল কি কতল হবে?
হ্যাঁ, ‘সিলেটের সুন্দরবন’ রাতারগুলে ইট ঢুকছে। দালান উঠছে। টাওয়ার হচ্ছে। ইটের রাস্তা হচ্ছে। মাটির সোঁদা-সৌন্দর্য ঢেকে দেবে পোড়া-ধূসর ইট। খোদ বন বিভাগ এ কাজ করছে।
বনের মধ্যবর্তী স্থান—নাম রাঙাকুড়ি। সেখানে পাঁচতলা উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হচ্ছে। বন বিভাগের যুক্তি, বনকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে! পাশে বন বিভাগের বিট কর্মকর্তার কার্যালয়। সেখানেও উঠছে আরেকটি পাকা দোতলা ভবন। সেটি হবে বিশ্রামাগার। ইট-বালুর শহর ছেড়ে পর্যটকেরা আসে বনে, প্রকৃতির কাছে। তাদের জন্য বন বিভাগের ইটের আয়োজন। টাওয়ার-বিশ্রামাগারে যেতে বনের ভেতর ১৫ ফুট চওড়া এক কিলোমিটার লম্বা রাস্তাও নির্মাণ করা হবে।
বন বিভাগ রাতারগুলকে ‘জাতীয় উদ্যান’ প্রস্তাব করে দ্রুত এসব অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। বরাদ্দ প্রায় ছয় কোটি টাকা। এর সিংহভাগ যাবে পূর্ত কাজে।
বনের ভেতর স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বনের প্রকৃতি ঠিক থাকবে? শঙ্কায় পরিবেশবাদীরা। রাতারগুলে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, ‘এখন বন রক্ষার স্বার্থে ব্যয়বহুল পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আর বিশ্রামাগার করতে হচ্ছে। এসব যখন ছিল না, তখন কি বন সুরক্ষা হয়নি? আমরা বনকে বনের মতোই রাখার পক্ষপাতী। স্থায়ী অবকাঠামো হলে রাতারগুল আর বন থাকবে না।’
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুল জলার বন (সোয়াম্প ফরেস্ট) হওয়ায় ১৯৭৩ সালে সংরক্ষিত ঘোষণা করে বন বিভাগ। নদী ও হাওরবেষ্টিত ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের পুরো এলাকা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা অজানা ছিল। ২০১২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রাতারগুলের একটি আলোকচিত্র নতুন করে পরিচিত করে তোলে একে।
‘বন বিভাগের সংরক্ষণ ব্যবস্থা মজবুত করতে’ সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার (ডিএফও) দপ্তর ‘রাতারগুল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য স্থাপন ও উন্নয়ন’ নামে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। প্রকল্পে রাতারগুলকে বাংলাদেশের একমাত্র সমৃদ্ধ জলার বন উল্লেখ করে বলা হয়, প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল-করচ-বরুণগাছের পাশাপাশি বেত, ইকরা, খাগড়া, মূর্তা ও শণজাতীয় গাছ রাতারগুলকে জলার বন হিসেবে অনন্য করেছে। বনে ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সঙ্গে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৭৫ প্রজাতির পাখি ও নয় প্রজাতির উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে।

রাতারগুল বনে নির্মাণ করা হচ্ছে বিশ্রামাগার । প্রথম আলো

প্রকল্পে প্রাণী ও বনসম্পদ রক্ষায় জলার বনকে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যে রূপান্তরে অবকাঠামো নির্মাণ করতে সম্ভাব্য ব্যয় পাঁচ কোটি ৬১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ টাকা বন অধিদপ্তরের থোক বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে সরবরাহ ও সেবা খাতে ২৫ লাখ টাকা, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন খাতে ৩৩ লাখ টাকা, সম্পদ সংগ্রহ ও ক্রয় বাবদ ৫৮ লাখ টাকা, বনায়ন ৩০ লাখ টাকা ব্যয় উল্লেখ করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয় নির্মাণ ও পূর্ত খাতে, চার কোটি ১৫ লাখ টাকা।
ব্যয়বহুল এ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন পরিবেশবাদীরা। জলার বনে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম প্রাকৃতিকভাবে হচ্ছে উল্লেখ করে বাপার কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুলতানা কামাল, যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল ও সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিমের নেতৃত্বে একটি দল গত বছরের ২২ আগস্ট রাতারগুল পরিদর্শন করে। রাতালগুলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা প্রাকৃতিকভাবেই হবে এবং এ ক্ষেত্রে বন বিভাগকে শুধু নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তাঁরা।
বন বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পরিবেশবাদীদের এ প্রতিক্রিয়ায় রাতারগুল নিয়ে প্রস্তাবিত সেই প্রকল্পটির ধরন পরিবর্তন করা হয়। বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য বাদ দিয়ে প্রস্তাব করা হয় জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) ঘোষণার। বর্তমানে উদ্যান পরিকল্পনায় প্রকল্পের সেই নির্মাণ ও পূর্ত খাতে চার কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে টাওয়ার, বিশ্রামাগার ও রাস্তা নির্মাণ চলছে।

রাঙাকুড়ি এলাকায় নির্মিত হচ্ছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার । প্রথম আলো

গত সপ্তাহে সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবন নির্মাণ প্রায় শেষের পথে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের চারটি সিঁড়ির কাজ শেষ হয়ে এখন চলছে অন্যান্য কাজ। এক কিলোমিটার দীর্ঘ ১৫ ফুট চওড়া রাস্তা হবে চিরিঙ্গি থেকে। বনের ভেতরে সৃষ্ট প্রাকৃতিক একটি মেঠোপথকে পাকা রাস্তায় রূপান্তর করা হবে। এ রাস্তার জন্য কাটা পড়বে অনেক গাছ।
প্রকল্প অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের মধ্যে টাওয়ার, ভবন ও রাস্তা নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। বাকি কাজ হবে পরবর্তী অর্থবছরে। সিলেট ডিএফওর কার্যালয়ের প্রস্তাবে এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে সরাসরি বন বিভাগের ‘ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড নেচার কনজারভেশন সার্কেল’-এর মাধ্যমে।
যোগাযোগ করলে সিলেটের সহকারী বন সংরক্ষক পরিমল চন্দ্র পাল প্রথম আলোর কাছে রাতারগুলের উন্নয়নে এসব হচ্ছে বলে জানান। বনের মধ্যে টাওয়ার, ভবন ও রাস্তা নির্মাণ করে বন সংরক্ষণ কীভাবে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে এ বিষয়ে আমি পুরোপুরি জানি না। এ ব্যাপারে ডিএফও (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) ভালো জানেন।’
সিলেটের ডিএফও দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি এ পদে নতুন যোগ দিয়েছি। রাতারগুলে কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, এটা শুনেছি। তবে বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘রাতারগুলসহ সিলেটের সব বনাঞ্চলের বর্তমান চিত্র সম্পর্কে অবহিত হতে রেঞ্জারদের সঙ্গে বৈঠক করব। তারপর এ ব্যাপারে বলতে পারব।’
একসময় দেশের উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম সব অঞ্চলে এমন জলার বন ছিল। অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কারণে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু পূর্বাঞ্চলের গুয়াইন নদের তীরে এ জলার বনটি কোনোমতে টিকে আছে। এর দক্ষিণে রয়েছে শিমুল বিল হাওর আর নেওয়া বিল হাওর। পাহাড়, নদী, জলার বন আর হাওর মিলিয়ে পুরো এলাকা প্রকৃতিবিদেরা প্রকৃতির জাদুঘর হিসেবে দেখেন।
বন্য প্রাণীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. আনিসুজ্জামান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব জলার বন ধ্বংস হওয়ার পর রাতারগুলকেও কতল করার উদ্যোগ চলছে। এমন অপরূপ বৈশিষ্ট্যের একটি বন একবার হারিয়ে গেলে শত চেষ্টায় আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বনটিকে প্রাকৃতিক জাদুঘর ঘোষণা করে তাতে পর্যটকদেরও অবাধে যাওয়া নিষিদ্ধ করা উচিত। বন বিভাগ তা না করে যদি অবকাঠামো নির্মাণ আর পর্যটকদের আরও বেশি যাতায়াতের ব্যবস্থা করে তাহলে তা এ দেশের সর্বশেষ জলার বনটি চিরতরে হারিয়ে যাবে।