রাতারগুলে খালা-ভাগনির ঘোরাঘুরি

রাতারগুলে নৌকাভ্রমণ। ছবি: লেখক
রাতারগুলে নৌকাভ্রমণ। ছবি: লেখক

গত বছরের ১৫ নভেম্বর, আমি আর খালামণি নাবিলা রাতারগুল পিকনিকে যাই। Travellers of Greater Sylhet-এর একঝাঁক ভ্রমণপিপাসু ছেলেমেয়ের সঙ্গে।

বিকেলে রাতারগুলের উদ্দেশে রওনা হই, সেখানে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। সেখানে পৌঁছেই সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করি। মৎস্য চাষের অসংখ্য বিল ছিল সেখানে, বিলের পানিতে সন্ধ্যা আকাশের বেগুনি-লালচে আভার প্রতিচ্ছবি মনটাকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করি। পরক্ষণেই সন্ধ্যা তারার আগমন, মিটমিট করে জ্বলতে থাকে আপন আলোয়।

আমরা সবাই একটা রিসোর্টে উঠি, ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে রিসোর্টটা ঘুরে দেখি। সবার মধ্যে লুডু খেলা হয়, ধামাইল নাচ হয়, হাসি, আড্ডায় মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। সবার সঙ্গে পরিচিত হই।

আমি অবশ্য একটু একা থাকতেই পছন্দ করি, একা একা প্রকৃতির নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত অনুভূতি আর সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। রিসোর্টের সামনের দিকে মৎস্য চাষের অনেকগুলো বিল, আর পেছনে যত দূর চোখ যায় বিশাল ধানখেত। সামনের একটি বিলের পাড়ে আমি আর খালামণি চেয়ার নিয়ে বসি, অসম্ভব সুন্দর মায়াবী চাঁদ আমাদের সঙ্গ দিতে চলে আসে, বিলের পানিতে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।

দূরে বহুদূরে ভারতের পাহাড় দেখা যাচ্ছিল, সেখানে মিটিমিটি বাতি জ্বলছিল আকাশের লাখ লাখ তারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে! ধানখেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জোনাকি পোকারাও ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে শুরু করে। রাতের আঁধারে এতসব আলোর ঝলকানি আর ঝিঁঝি পোকাদের শব্দ সমস্ত পরিবেশটাকে রূপকথার মায়াপুরীতে পরিণত করে। এসব দৃশ্য আমায় পাগল করে দেয়, রাতের গভীরে কতটা সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, সেটা সেদিন উপলব্ধি করতে পারি...

রাতারগুল ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো এলাকা সবুজ দেখা যায়। ছবি: লেখক

রাতের খাবার শেষে সবাই চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে গানের কলি খেলা শুরু করি, রিসোর্টের একটা বাচ্চা শিল্পী ছিল আমাদের মধ্যমণি, তার ভাটিয়ালি গান সবার মন কেড়ে নেয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলে গানের আসর। এরপর শুরু হয় বারবিকিউ পার্টি, রিসোর্টের বাবুর্চিরা বাইরে চিকেন বারবিকিউ করছিল, আর আমরা ঠান্ডা কুয়াশাচ্ছন্ন ওই পরিবেশে গরম চা নিয়ে সেটা উপভোগ করছিলাম, আর নানা রকম গল্প করছিলাম।

সবশেষে অনেক মজার সেই বারবিকিউ চিকেন খাওয়া শেষ করে তাঁবুতে যাই ঘুমোতে। আমি আর নাবিলা খালামণি একটি তাঁবুতে ঘুমোই, প্রথমবারের মতো তাঁবুতে রাত্রি যাপনের উত্তেজনায় দুজনেরই ঘুম আসছিল না...।

সকালে ঘুম ভাঙতেই তাঁবু থেকে বের হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন সবুজ ধানখেতের বুকে লাল সূর্যোদয় দেখে দুচোখ জুড়িয়ে যায়। লাল রক্তিম সূর্যের আলোয় শিশিরভেজা ধানগাছগুলো চিকচিক করছিল, কী অপরূপ সে দৃশ্য! সকালের নাশতা শেষ করে সকাল সাতটায় বের হই রাতারগুলে নৌকাভ্রমণের উদ্দেশ্যে।

ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম প্রিয় জায়গা রাতারগুল। ছবি: লেখক

রিসোর্ট থেকে অল্প কিছু দূর হেঁটেই পৌঁছে যাই নৌঘাঁটিতে। নৌকাভ্রমণের সময় মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, বৈঠার আঘাতে পানির চিরচির শব্দ আর বনের পাখিদের কিচিরমিচির ডাক চারপাশের সৌন্দর্যকে আরও বড়িয়ে তোলে! বনের সবুজ গাছগুলো যেন পানির ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছিল! সত্যি, রাতারগুল বনে পানির মধ্যে অর্ধ ডুবন্ত সেই গাছগুলোর সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব! রাতারগুল ভ্রমণের মাধ্যমে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনভূমি দেখার ইচ্ছা কিছুটা হলেও পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। কিছু জায়গায় পানি শুকিয়ে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ তৈরি হয়, একটা দ্বীপে নৌকা থেকে নেমে ঘুরে দেখি চারপাশ। ঝরা পাতার সৌন্দর্য আর উঁচু উঁচু গাছের শিকড় আমি অবাক চোখে দেখছিলাম।

সবশেষে রাতারগুল ওয়াচ টাওয়ারে উঠে নিচের সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখি আমরা...। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয়, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে কাছ থেকে দেখার আনন্দসহ নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরি আমরা। স্মৃতির পাতায় আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ওই দিনের সব ভালো লাগা...।


*শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, স্নাতকোত্তর, এম সি কলেজ, সিলেট