রাজাদের উত্সব, বীরদের খেল

আঞ্চলিক পর্ব থেকে বিজয়ী হয়ে জাতীয় উৎসবের টিকিট পেয়েছিল ৭৪৪ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পুরস্কার পেয়েছে ৭২ জন। ছবি: প্রথম আলো
আঞ্চলিক পর্ব থেকে বিজয়ী হয়ে জাতীয় উৎসবের টিকিট পেয়েছিল ৭৪৪ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পুরস্কার পেয়েছে ৭২ জন। ছবি: প্রথম আলো

১৯ মে খুব সকালেই ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে যে ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছিল, তাদের অধিকাংশের চোখে-মুখে ছিল ক্লান্তি আর রোমাঞ্চের মিশেল। এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগ ২০১৭-এর জাতীয় উত্সব শুরু হতে তখন অল্প কিছুক্ষণ বাকি, রোমাঞ্চের কারণটা তাই অনুমান করা যায়। ক্লান্তিটা কেন? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল চট্টগ্রাম থেকে আসা এক অভিভাবকের কাছে, ‘আমরা রাত দশটায় গাড়িতে উঠেছি। ঢাকায় এসে নামলাম সকাল আটটায়।’

সেরা বানানবীরদের সঙ্গে এইচএসবিসির ডেপুটি সিইও মাহবুবুর রহমান (বাঁ থেকে তৃতীয়), কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও বানানবীর পর্বের সঞ্চালক হারুন অর রশীদ

ঢাকা অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা তো আছেই। খুলনা, জয়পুরহাট, ফেনী, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, ঝিনাইদহ, রংপুর ও পটুয়াখালী অঞ্চল থেকেও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিজয়ী ও তাদের অভিভাবকেরা এসেছিলেন। অনেকেই সারা রাতের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছেন, কেউ রওনা হয়েছিলেন খুব ভোরে। সকাল নয়টার তাতানো সূর্য অবশ্য ক্লান্ত মুখগুলোর প্রতি মায়া দেখাল না একটুও। তাতে কী! বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও অন্য অতিথিদের হাত ছেড়ে বেলুন যখন আকাশে উড়ল, উড়ে গেল ক্লান্তির ছিটাফোঁটাও। ১২টি অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা ৭৪৪ জন বিজয়ী তখন আরেকটি চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত!
ওহ্, একটু ভুল হলো। ভাষা প্রতিযোগে পরীক্ষাকে পরীক্ষা নয়, বলা হয় ‘পরীক্ষা পরীক্ষা খেলা’। অতএব, অংশগ্রহণকারীদের পরীক্ষার্থী না বলে ‘খেলোয়াড়’ বলাই শ্রেয়! সত্যি সত্যিই একজন পেশাদার খেলোয়াড়ও অবশ্য এসেছিলেন এই অনুষ্ঠানে। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়। শিক্ষার্থীদের মজার সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। এক শিক্ষার্থী যেমন ছুড়ে দিল একটা সরল প্রশ্ন, ‘আপনি এখন আর জাতীয় দলে খেলেন না কেন?’ বিজয় হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘সারা দেশে আমরা হাজার হাজার মানুষ ক্রিকেট খেলি। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায় মাত্র ১১ জন। তোমরা দোয়া কোরো, সামনে হয়তো আমি আবার খেলব।’
বিজয় ছাড়াও শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানাতে মঞ্চে উঠেছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, লেখক আনিসুল হক। এসেছিলেন অভিনয়শিল্পী অপি করিম। অপি করিম কিন্তু শিক্ষকতাও করেন। তাই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় পর্ষদের সভাপতি সাইদুজ্জামান রওশনের অনুরোধে এক মিনিটের একটা ক্লাস নিতে হলো তাঁকে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যখন, যেখানেই কথা বলবে, সুন্দর করে কথা বলবে। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসার এটাই হলো বহিঃপ্রকাশ।’ দুপুরের বিরতির আগে শেষ আকর্ষণ ছিল জাদুশিল্পী স্বপন দিনারের পরিবেশনা।
ভাষা প্রতিযোগের প্রতিটি পর্বের শেষে ‘আমরা সবাই রাজা’ প্ল্যাকার্ড হাতে মঞ্চে দেখা যায় বিজয়ীদের। এবার রাজাদের সঙ্গে মঞ্চে উঠেছিল বাংলার বারো ভূঁইয়াও! তারা কারা? ১২ অঞ্চল থেকে আসা ১২ জন বানানবীর। বানানবীর পর্বের সঞ্চালক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুন অর রশীদ বারো ভূঁইয়া বলেই প্রতিযোগীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর শুরু হলো বানানের যুদ্ধ! ঈষদুষ্ণ, চেঁচামেচি, কূপমণ্ডূক কিংবা ব্রাহ্মমুহূর্ত...কোনো শব্দেই বানানবীরদের কুপোকাত করা যাচ্ছিল না। তুমুল লড়াই শেষে সেরা বানানবীরের ট্রফি জিতে নিয়েছে ময়মনসিংহ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রী ফারিহা নুজহাত। আর এবারের ভাষা প্রতিযোগে সেরাদের সেরা হলো কে? ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র জীম মীম সিদ্দিকী।
জাতীয় উত্সবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছেন কুদরত-ই-হুদা। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। না, তিনি একা নন। আরও ছিলেন অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক, সৌমিত্র শেখর, মাহবুব বোরহান, এইচএসবিসির ডেপুটি সিইও ও হেড অব কমার্শিয়াল ব্যাংকিং মাহবুবুর রহমান এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
অনুষ্ঠানে গান শুনিয়েছেন শিল্পী মিনার। তাঁর বৃষ্টির গান ‘ঝুম’ কিংবা প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক অরুণ বসুর ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ আবৃত্তির জন্যই কি না কে জানে, বিকেলে আবহাওয়াটা বদলে গেল হঠাৎ। দারুণ সব অভিজ্ঞতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন বাড়ি ফিরছে, আকাশ তখন মেঘের দখলে।

সেরাদের সেরা
যেকোনো প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেলেই অংশ নিই। ভাষা প্রতিযোগে এবার দ্বিতীয়বার এলাম। সেরাদের সেরা হয়ে খুব ভালো লাগছে। বড় হয়ে আমি গুগলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।
জীম মীম সিদ্দিকী, ঢাকা

সেরা বানানবীরদের সঙ্গে এইচএসবিসির ডেপুটি সিইও মাহবুবুর রহমান (বাঁ থেকে তৃতীয়), কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও বানানবীর পর্বের সঞ্চালক হারুন অর রশীদ

সেরা বানানবীর
অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যেই এসেছিলাম। চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাব, সেটা ভাবিনি। এমনকি বানানবীর প্রতিযোগিতার জন্য আলাদা করে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়নি। ছোটবেলা থেকেই আমি বানানের ব্যাপারে সচেতন। নিয়মিত পত্রিকা পড়ি, বই পড়ি। সেটাই কাজে লেগেছে।
ফারিহা নুজহাত, ময়মনসিংহ

কিছু মুহূর্ত

‘কে কে একক অভিনয় করতে পারো?’ সঞ্চালকের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মঞ্চটা নিজের করে নিয়েছিল খুলনার মারজানা আফরিন

‘হান্ড্রেড মিলিয়ন ফর হান্ড্রেড মিলিয়ন’ প্রচারণার অংশ হিসেবে শপথ পাঠ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেছিল, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ আমরাই গড়ব।’

ঝটপট বলতে হবে, ‘হাঁসের ঠোঁট চ্যাপ্টা, মুরগির ঠোঁট চোখা!’ বারবার বলতে গিয়ে ওলট–পালট হয়ে যাচ্ছিল। তাই শুনে হাসির রোল উঠল দর্শকদের মধ্যে।

কী গভীর মনোযোগ! কলম মুখে দিলেই যে প্রশ্নের উত্তরটা চট করে মাথায় চলে আসবে, তা নিশ্চয়ই নয়!