সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা সংসদীয় কমিটির অন্যতম কাজ। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করারও সুযোগ রয়েছে। সংসদীয় কমিটি ও সংসদের কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন নিজাম উদ্দিন আহমদ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংসদের (পার্লামেন্ট) কার্যক্রম নিয়ে তাঁর বই রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় সংসদীয় কমিটি অনেকটা ‘দন্তবিহীন বাঘ’। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং ইমাম হোসেন সাঈদ।
প্রথম আলো: সরকার বা মন্ত্রণালয়ের কাজ জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসার বড় মাধ্যম সংসদের স্থায়ী কমিটি। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটিগুলোর মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না। এটি কি দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, নাকি সংসদীয় রীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে সাংসদদের দক্ষতার ঘাটতি?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: সংসদীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠানের সংখ্যা এবং সদস্যদের সভায় উপস্থিতির হার—উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে আছে। প্রতিবেশী ভারতে একটি সংসদীয় কমিটি বছরে গড়ে ২৩টি সভা করে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় যেমন: ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সংসদীয় কমিটিগুলো প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে সভা করে। বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটিগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হলো কমিটির সদস্যদের প্রধান পেশা রাজনীতি নয়। রাজনীতি তাঁদের খণ্ডকালীন পেশা। এসব সদস্যের মূল আনুগত্য থাকে তাঁদের প্রধান পেশার প্রতি, যেমন ব্যবসা। সংসদীয় কমিটির কাজে ব্যয় করার মতো পর্যাপ্ত সময় তাঁদের নেই। সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিও কম সভা অনুষ্ঠানের একটি বড় কারণ।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি এক/একাধিক সাবকমিটি গঠন করে। এসব সাবকমিটির সভা কমিটির সভা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এটিও বাঞ্ছনীয় নয়।
৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে ৩৯টি কমিটিই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত। এসব কমিটি মন্ত্রণালয়ের গুরুতর অনিয়ম বা দুর্নীতি নিয়ে খুব একটা সোচ্চার থাকে না। এর কারণ কী বলে মনে হয়?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম–দুর্নীতি সম্পর্কে সংসদীয় কমিটিগুলোর সোচ্চার না থাকার কারণ তিনটি। এক. কাঠামোগত, দুই. আচরণগত ও তিন. বিধিসংক্রান্ত। প্রথমত, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে কোনো কমিটির উন্মুক্ত সভা করার বিধান নেই। কমিটির সদস্য এবং সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা ছাড়া অন্য কেউ সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন না। ফলে কমিটিতে কী আলোচনা হয় বা কমিটি কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা জানার সুযোগ সীমিত।
দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলবিহীন সংসদ যেমন অকার্যকর থাকে, তেমনি সংসদীয় কমিটিও অনেকটা ‘দন্তবিহীন বাঘ’ হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা সরকারের কার্যক্রম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় যাতে না ফেলেন, এ ধরনের অলিখিত সতর্কবাণী থাকে। আবার কমিটির কোনো সদস্য ‘অতিমাত্রায় আগ্রহী’ হলে তিরস্কারের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান যদিও সংসদীয় কমিটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবু কোনো সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন—এমন উদাহরণ নেই।
তবে অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলা যায়, সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের ভারসাম্য থাকলে সংসদ ও কমিটি—উভয়ই কার্যকর থাকার সম্ভাবনা বেশি।
বাংলাদেশে পঞ্চম (১৯৯১-৯৫) ও সপ্তম (১৯৯৬-২০০১) সংসদকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। বিরোধী দলের চাপের মুখে পঞ্চম সংসদে সরকারকে অনেক ব্যাপারে ছাড় দিতে হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে আর দেখা যায়নি। পঞ্চম সংসদে সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির চেয়ারম্যান সরকারদলীয় এক সদস্যের অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে মন্তব্য করে রিপোর্ট প্রদান করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। পরে স্পিকারের হস্তক্ষেপে ওই রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হয়।
সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে একধরনের ভারসাম্যের কারণে সপ্তম সংসদেও কমিটিগুলো, বিশেষ করে স্বাস্থ্য কমিটি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে বেশ সোচ্চার ছিল। কিন্তু দশম ও একাদশ সংসদে বিরোধী দলের কার্যত কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সংসদ ও কমিটিগুলো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশের তুলনায় ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যে কমিটিগুলো অনেক বেশি সক্রিয় এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে সোচ্চার। এর প্রধান কারণ দুটো। প্রথমত, কমিটিগুলো বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বশীল এবং দ্বিতীয়ত: (দলীয়) সংখ্যানুপাতে ওই দেশগুলোয় সংসদীয় কমিটির সদস্য ও সভাপতির পদ নির্ধারিত হয়। ওই তিন দেশেই বিরোধী দল থেকে সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বিরোধীদলীয় সভাপতিরা চেষ্টা করলে দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত বিষয়গুলো কমিটির কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন, যা বাংলাদেশ অনেকটা অসম্ভব।
এ ছাড়া ভারত ও যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির (ও অন্যান্য কিছু কমিটির) সদস্য হতে পারেন না। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মন্ত্রীরা পদাধিকারবলে সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য হন। অতএব মন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁর মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন অথবা তদন্ত করার বিষয়টি অনেকটা কাল্পনিক। ‘মন্ত্রীর দর্শন’ পেতে কমিটির সদস্যরা যেখানে উদ্গ্রীব থাকেন এবং একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, সেখানে বিরোধী দলবিহীন কমিটিতে মন্ত্রণালয় সম্পর্কে, বিশেষ করে অনিয়ম ও দুর্নীতিসংক্রান্ত কোনো বিষয় উত্থাপন করা অনেকটা অসম্ভব।
আওয়ামী লীগের গত সরকারে (দশম সংসদ) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ১৫ জন মন্ত্রীকে (এখন আর মন্ত্রী নন) একাদশ সংসদে একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি (যেমন:¦শ্রম ও কর্মসংস্থান, শিল্প ও বাণিজ্য) করা হয়েছে। তাঁদের দায়িত্ব দেওয়ার সময় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এতে বর্তমান মন্ত্রীদের জবাবদিহি করা যাবে। কিন্তু টিআইবি বলছে, এতে একধরনের স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়েছে। এই মূল্যায়ন সঠিক হলে কমিটির কার্যক্রম কীভাবে গতিশীল হবে?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: সাবেক মন্ত্রীদের সংসদীয় কমিটির সভাপতি করার প্রধান অসুবিধা হলো যে এর ফলে ‘কেঁচো খুঁড়ে সাপ’ আর কখনো বের হবে না। টিআইবি যথার্থই বলেছে যে এখানে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হবে। এ ছাড়া যাঁদের সভাপতি করা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই এটাকে পদাবনতি হিসেবে বিবেচনা করেন। মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে কোনো বিষয় দাঁড় করানো যথেষ্ট কষ্টকর হবে। কেননা, কোনো মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা অতি সহজে তাঁদের কাজের মূল্যায়নের দায়িত্ব অন্যের কাছে দিতে আগ্রহী হবেন না। কমিটির সদস্যরাও খুব সহজাত কারণে ‘অতীত মন্ত্রী/সভাপতির’ তুলনায় ‘বর্তমান’ মন্ত্রীর পক্ষ অবলম্বন করতে অধিকতর আগ্রহী হবেন। কারণ, তাঁকেই তাঁদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিরোধী দলবিহীন সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করার সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী রূপে কম। অতএব কে সভাপতি হলেন, তা তেমন গুরুত্ব বহন করে না।
‘অভিজ্ঞতা অর্জন’ ও ‘শিক্ষা সফরের’ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়ের টাকায় বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের বিদেশ সফরে যাওয়া নতুন নয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রের সংসদীয় কমিটি নয়টি দেশে পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যক্রম দেখার জন্য ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। দেশের বাস্তবতায় সংসদীয় কমিটির এ ধরনের সফর কতটা কার্যকর?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: ‘অভিজ্ঞতা অর্জন’ ও ‘শিক্ষা সফরের’ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়ের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ শুধু অনৈতিক নয়, এটা আইনসংগত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। ‘তদন্তের’ প্রয়োজনে কোনো কমিটির বিদেশ সফরে যাওয়ার কোনো বাধা থাকার কথা নয়। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংসদের বাজেট থেকে জোগান দেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে অতীতেও অনেক কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি সাবেক অর্থমন্ত্রী একাধিকবার এ বিষয়ে তাঁর বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কী কারণে সংসদ সচিবালয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখে না অথবা কমিটিগুলো স্পিকারের কাছে এ ব্যাপারে কোনো দাবি করে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। মন্ত্রণালয়ের টাকায় বিদেশ সফর করে মন্ত্রণালয়কে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা নয়।
একাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবু কমিটির কার্যক্রমকে গতিশীল করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সংসদ নেতা এবং স্পিকার কোনো উদ্যোগ নেবেন, এমন সুযোগ রয়েছে কি না?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: সংসদীয় পরিভাষায় গতিশীল বলতে সাধারণত চার থেকে পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত কমিটির সভার সংখ্যা, সদস্যদের উপস্থিতির হার, সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের সংখ্যা, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার এবং গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রকৃতির ওপর। অতীতের তুলনায় অবশ্য বর্তমানের কমিটিগুলো অধিকতর সভা আহ্বান করছে এবং সদস্যদের মধ্যে কমিটির সভায় যোগদানের প্রবণতা বেড়েছে।
কিন্তু মূল সমস্যা হলো কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে শ্লথগতি অতিমাত্রায় লক্ষণীয়। বিভিন্ন কমিটি অনেকটা রুটিনমাফিক অভিযোগ করে থাকে যে মন্ত্রণালয়গুলো কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদাসীন থাকে। এ ব্যাপারে অবশ্য কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না যে কত ভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় এবং কত ভাগ অবাস্তবায়িত থাকে অথবা মন্ত্রণালয়গুলো কোন ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধিকতর আগ্রহী–অনাগ্রহী থাকে। অন্যান্য দেশ এ ধরনের সমস্যা নিরসনের জন্য যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করছে, তা আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
যেমন ভারতে প্রতিটি কমিটিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট (কী ব্যবস্থা নিল মন্ত্রণালয়) জমা দিতে হয়। এসব রিপোর্টে কমিটির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সংসদকে (এর মাধ্যমে জাতিকে) অবহিত করা হয়। প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে প্রতি ছয় মাস পর মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির নেওয়া গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে সংসদে রিপোর্ট পেশ করতে হয়। যুক্তরাজ্যে এই সময়কাল দুই মাস। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে তা তিন মাস, কানাডায় চার মাস। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। এ কারণে সংসদীয় কমিটি কী কাজ করছে, তা জানা অনেকটা অসম্ভব।
বাংলাদেশে অধিকাংশ কমিটি সংসদের মেয়াদের শেষের দিকে রিপোর্ট জমা দেয়। এগুলোকে সত্যিকার অর্থে রিপোর্ট বলা দুষ্কর। এসব রিপোর্টে শুধু বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণী উল্লেখ থাকে। সংসদে এসব রিপোর্টের ওপর কখনো কোনো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটিগুলোর কাজ করার ক্ষমতা সীমিত। বিশেষ করে বাজেটসংক্রান্ত বিষয়ে কমিটির কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। কার্যপ্রণালি বিধিতে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাজেট কোনো কমিটিতে প্রেরণ করা যাবে না। অন্যদিকে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সংসদীয় কমিটিগুলোর বাজেট নিরীক্ষণ ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করে।
এসব সমস্যার সমাধানের জন্য সংসদ নেতা এবং স্পিকারের উদ্যোগ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমকে অধিকতর স্বচ্ছ এবং এসব কমিটির কার্যক্রমের ব্যাপারে, বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ের আচরণ সম্পর্কে, সংসদকে (ও জনগণকে) অবহিতকরণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমে অধিক মাত্রায় গোপনীয়তা স্বচ্ছতার পরিপন্থী। বর্তমান কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী কোনো কমিটি বিধিমাফিক সভা না করলে স্পিকার ওই কমিটির সভা আহ্বান করতে পারেন। কিন্তু কমিটি সভা কীভাবে করবে অথবা কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এ ক্ষেত্রে স্পিকারের হস্তক্ষেপ জরুরি।
করোনা মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সরকারের ভেতরেই নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি নীরব থাকল।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে তিন মাস প্রায় সবকিছু বন্ধ ছিল, স্থবির ছিল। আবার জীবন বাজি রেখে কর্ম সম্পাদনের বিষয়টি হয়তো সবার থেকে প্রত্যাশা করা সমীচীন হবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে (অন্যান্য মন্ত্রণালয় নিয়েও কমবেশি একই মূল্যায়ন করা যায়) জবাবদিহির আওতায় আনা অত্যন্ত দুষ্কর।
মন্ত্রীদের জবাবদিহি করার জন্য প্রশ্নোত্তর পর্ব সংসদীয় ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূরক প্রশ্নে মূল বিষয়ের বাইরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আসেন সাংসদেরা। আবার বিএনপির এক সাংসদ গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সংসদের অধিবেশনেই অভিযোগ করেন, তাঁর জমা দেওয়া প্রশ্ন পরিবর্তন করা হয়েছে। স্পিকার বিষয়টি দেখবেন বলে তখন আশ্বাস দেন। পরে এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: সম্পূরক প্রশ্নে মূল বিষয়ের বাইরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। এটা শুধু আমাদের সংসদে নয়, অন্যান্য সংসদেও অনেক সময় এটা পরিলক্ষিত হয়। পার্থক্যটা শুধু ‘মাত্রার’। কিন্তু জমা দেওয়া প্রশ্নের পরিবর্তন করা শুধু গর্হিত কাজই নয়, এটা বেআইনি ও অনৈতিক। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী কোনো প্রশ্ন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার একমাত্র স্পিকারের। কিন্তু প্রশ্ন পরিবর্তন করার অধিকার নেই। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সংসদ সদস্যদের অধিকার যাতে খর্ব না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান এবং সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী এই কমিটি কোনো নতুন সংসদের প্রথম বৈঠকে গঠন করতে হয়। জমা দেওয়া প্রশ্ন পরিবর্তন করা সংসদ সদস্যদের অধিকার খর্ব করা এবং সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধি লঙ্ঘনের শামিল। এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা প্রকাশ বাঞ্ছনীয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্ত্রীরা প্রশ্নের সঠিক জবাব দেন না বা ভুল উত্তর দেন—এমন অভিযোগও তুলেছেন বিএনপির সাংসদেরা। কী বলবেন।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্ত্রীরা সঠিক জবাব দেন না অথবা ভুল উত্তর দেন—এই অভিযোগ নতুন নয়। অতীতেও এ ধরনের অভিযোগ এসেছিল। পঞ্চম সংসদের (১৯৯১-৯৬) বিরোধী দলের নেতা একাধিকবার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। এমনকি পঞ্চম সংসদে সরকারি দলের উপনেতা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রশ্নোত্তর পর্বে ‘অসত্য’ তথ্য প্রদানের অভিযোগ করেছিলেন। অন্য এক সদস্য শিক্ষামন্ত্রী ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য প্রদান করে তাঁর অধিকার খর্বের অভিযোগ উত্থাপন করেন। স্পিকার এটা বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত কমিটিতে প্রেরণ করেন।
একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম বছরের (২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) পাঁচটি অধিবেশন ও সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি গবেষণা প্রতিবেদন (পার্লামেন্ট ওয়াচ) প্রকাশ করেছে টিআইবি। তাতে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে বলা হয়, অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। এই বাস্তবতা অবশ্য মানতে চান না সংসদ সদস্যরা। অথচ কমিটিগুলো কাউকে জবাবদিহিও করছে না।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: টিআইবি যথাযথ তথ্য প্রদান করেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অতএব, এই রিপোর্ট নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের জবাবদিহির প্রধান সূচক হলো সরকার কীভাবে নির্বাচিত হয়, তা দেখা। নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়াদি যদি বিতর্কের ঊর্ধ্বে না থাকে, তাহলে কোনো সংসদের পক্ষেই সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বের ধরনের ওপর জবাবদিহি অনেকাংশে নির্ভর করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রথম সংসদে (১৯৭৩ সালের নির্বাচনে) প্রতিনিধিত্ব করা সাংসদের ১৮ শতাংশের পেশা ছিল ব্যবসা। আর বর্তমান একাদশ সংসদের ৬১ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সংসদ কার্যক্রমকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে—এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ আছে কি না।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: বাংলাদেশে ‘ব্যবসার জন্য রাজনীতি’—এ প্রবণতা অতিমাত্রায় লক্ষণীয়। পেশা হিসেবে রাজনীতির কদর ক্রমে কমে যাচ্ছে। এর প্রতিফলন ঘটছে সংসদে এবং সংসদীয় রাজনীতিতে। পেশাজীবী রাজনীতিবিদদের সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সংসদে কোরাম সংকট, অতি দ্রুত আইন পাস এবং মৌলিক বিষয়ের ওপর উল্লেখযোগ্য আলোচনা না হওয়া—এ সবকিছুর অন্যতম কারণ সংসদে খণ্ডকালীন রাজনীতিবিদদের (ব্যবসায়ী) সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতিকে ফিরিয়ে দেওয়া।
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর নিয়ম রক্ষার বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে জাতীয় পার্টি। প্রধান বিরোধী দল সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন কি?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: হ্যাঁ। তবে একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মৌলিক বিষয়ে (যেগুলোকে সাধারণত ‘রুলস অব গেম’ হিসেবে অভিহিত করা হয়) ঐকমত্য আবশ্যক। কিন্তু বিরোধী দল যখন সরকারের গৃহীত প্রায় সব বিষয়ে বিরোধিতা করে (যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) এবং বিরোধী দল যখন সরকারের সব বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে (যেমন আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক বিরোধী দলগুলো), তখন সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়, যেটা বর্তমানে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় লক্ষণীয়। বর্তমানে সংসদে সরকারের স্তাবকতাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে সংসদে সংসদীয় গণতন্ত্রকে গতিশীল ও কার্যকর করতে হলে বড় দলগুলোর নেতৃত্বে ‘আচরণগত’ পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।